ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

পারিবারিক আদালতের এখতিয়ার সম্প্রসারণ ও প্রাসঙ্গিকতা

পারিবারিক আদালতের এখতিয়ার সম্প্রসারণ ও প্রাসঙ্গিকতা

আশফাকুর রহমান

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২০ | ০২:১৬

দীর্ঘসূত্রতা এড়িয়ে স্বল্প সময়ে সহজতম পদ্ধতিতে বিচারপ্রার্থী জনগণকে বিচারিক সেবা প্রদানে বাংলাদেশ বিচার বিভাগ বদ্ধপরিকর। কিন্তু বিচারিক সেবা প্রাপ্তিতে পদ্ধতিগত জটিলতা, এখতিয়ারগত সীমাবদ্ধতাসহ বেশকিছু প্রতিবন্ধকতার প্রেক্ষিতে কতিপয় ক্ষেত্রে বিচারিক সেবা প্রদানে আদালতকে যেমন দীর্ঘসূত্রতায় পড়তে হয়, তেমনি বিচারপ্রার্থী জনগণকেও যথেষ্ট ভোগান্তি পোহাতে হয়। যেমন পারিবারিক বিরোধকে বিশেষ শ্রেণির বিরোধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তা নিষ্পত্তির জন্য 'পারিবারিক আদালত' নামে বিশেষ আদালত গঠন করা হলেও সব ধরনের পারিবারিক বিরোধ বা অপরাধকে এই আদালতের এখতিয়ারভুক্ত করা হয়নি। ফলে একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পারিবারিক বিরোধ বা অপরাধের ক্ষেত্রেও বিচারপ্রার্থীকে ভিন্ন ভিন্ন আদালতে পৃথক পৃথকভাবে মোকদ্দমা দায়ের করতে হয়।

যৌতুক দাবির ঘটনার জের ধরে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী বিতাড়িত হয়ে ভরণপোষণপ্রাপ্ত না হলে স্ত্রীকে ভরণপোষণ প্রাপ্তির জন্য 'পারিবারিক আদালতে' যৌতুক দাবি সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য যৌতুক নিরোধ আইনে 'জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে' আবার যৌতুককে কেন্দ্র করে সংঘটিত সহিংসতার বিচারের জন্য 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে' পৃথক পৃথকভাবে মামলা দায়ের করতে হয়। শুধু বিচারের পদ্ধতি ও প্রতিকারের প্রকৃতিগত ভিন্নতার কারণে বিচারিক ফোরাম পৃথক হওয়ায় একই ঘটনার জন্য ভিন্ন ভিন্ন আদালতে পৃথক পৃথক মোকদ্দমা দায়ের করতে হয়। এতে অনাবশ্যকভাবে মামলার আধিক্যতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিচারপ্রার্থী জনগণকে প্রতিকার প্রাপ্তিতে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।

তাই পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ আইনের ৫ ধারা সংশোধন করে দেওয়ানি ফৌজদারিসহ সব রকমের পারিবারিক বিরোধ বা অপরাধকে পারিবারিক আদালতের এখতিয়ারভুক্ত করা বাঞ্চনীয়। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ আইনের ৫ ধারা মোতাবেক দেনমোহর, খোরপোশ, বিবাহ বিচ্ছেদ, নাবালকের জিম্মা ও অভিভাবকত্ব, দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার ইত্যাদি ৫টি পারিবারিক বিরোধের ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতের এখতিয়ার রয়েছে। পারিবারিক আদালত উক্ত ৫টি পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গিয়ে পক্ষদ্বয়ের মধ্যে বিয়ে হয়েছে কিনা বা কাবিননামা সঠিক কিনা, নাবালক সন্তান বৈধ কিনা ইত্যাদি নির্ধারণ করতে পারে। কিন্তু শুধু বিয়ের বৈধতাকে বা কাবিননামার বিশুদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করে পৃথক ও এককভাবে পারিবারিক আদালতে কোনো মোকদ্দমা দায়ের করা যায় না। 'বিয়ের বৈধতা' বা 'কাবিননামার সঠিকতা' নির্ধারণ প্রকৃতিগতভাবে পারিবারিক বিরোধ হলেও বর্তমানে বিয়ের বৈধতাকে বা কাবিননামার বিশুদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করে 'দেওয়ানি আদালতে' মোকদ্দমা দায়ের করতে হয়। এতে করে একই কাবিননামার ওপর ভিত্তি করে স্ত্রী কর্তৃক 'পারিবারিক আদালতে' দেনমোহরের মোকদ্দমা এবং 'দেওয়ানি আদালতে' স্বামী কর্তৃক কাবিননামা বাতিলের মোকদ্দমা দায়েরের আশঙ্কা থাকে। দুটি ভিন্ন আদালতে মোকদ্দমা থাকায় বিচারপ্রার্থীদের যেমন ভোগান্তি হয় তেমনি একই কাবিননামার সঠিকতা বিষয়ে দুটি পৃথক মামলায় সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্ত হলে তা ন্যায়বিচারে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করণার্থে ও বিচারপ্রার্থী জনগণের সুবিধার্তে তাই 'বিয়ের বৈধতা' এবং 'কাবিননামার বিশুদ্ধতা' নির্ধারণের বিষয় দুটিকে পারিবারিক আদালতের এখতিয়ারভুক্ত করা সমীচীন।

শুধু তাই নয়, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ এর অধীনে 'পারিবারিক সহিংসতা', যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮-এর অধীনে 'যৌতুক দাবির অপরাধ', পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩-এর অধীনে 'পিতা-মাতার ভরণপোষণে অস্বীকৃতির অপরাধ', নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ (গ) ধারার অধীনে 'যৌতুকের দাবিতে আঘাতের অপরাধ' ইত্যাদি অপরাধ পারিবারিক অপরাধ হলেও এবং পারিবারিক আদালত (জারি মোকদ্দমার ক্ষেত্রে) প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া সত্ত্বেও এসব অপরাধ বিচারের এখতিয়ার পারিবারিক আদালতের নেই। অথচ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বিচার্য এসব পারিবারিক অপরাধের সঙ্গে পারিবারিক আদালতের এখতিয়ারভুক্ত দেনমোহর-ভরণপোষণ, বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের মতো পারিবারিক বিরোধের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বিচার্য এসব পারিবারিক অপরাধের বিচারের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে। ফলে আইনগত জটিলতা এড়াতে ও বিচারিক সেবা সহজীকরণের নিমিত্তে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ আইনের ৫ ধারা সংশোধন করে 'পারিবারিক সহিংসতা', 'যৌতুক দাবির অপরাধ', 'পিতা-মাতার ভরণপোষণে অস্বীকৃতির অপরাধ', 'যৌতুকের দাবিতে আঘাতের অপরাধ'-কে পারিবারিক আদালতের এখতিয়ারাধীন করা আবশ্যক। এ উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ডিক্রি জারি মামলার পাশাপাশি মূল পারিবারিক মোকদ্দমাতেও পারিবারিক আদালতকে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা অর্পণ ও ফৌজদারি কার্যবিধি প্রয়োগ করার এখতিয়ার প্রদান করা উচিত। উল্লেখ্য, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানেও 'বিয়ের বৈধতা' 'কাবিননামার সঠিকতা' 'সন্তানের বৈধতা', 'যৌতুক দাবি' ইত্যাদি পারিবারিক বিরোধের ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।

বর্তমানে প্রতিটি উপজেলায় একজন সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ 'দেওয়ানি বিচারিক আদালতের' বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সংশ্নিষ্ট উপজেলার 'পারিবারিক আদালতের' দায়িত্ব পালন করেন। ফলে পারিবারিক আদালতের বিচারকার্য পরিচালনার জন্য পৃথক ও একক কোনো বিচারক না থাকায় পারিবারিক আদালত আশানুরূপভাবে পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করতে সমর্থ হচ্ছে না। এমতাবস্থায় প্রতিটি জেলায় দুই বা ততোধিক পৃথক ও স্বতন্ত্র 'পারিবারিক আদালত' গঠন করে প্রতিটি পারিবারিক আদালতের জন্য একজন করে বিচারক নিযুক্ত করা উচিত, যিনি পারিবারিক আদালতের বিচারক হিসেবে শুধু পারিবারিক মামলাগুলোই নিষ্পত্তি করবেন। তাছাড়া একই পারিবারিক মোকদ্দমায় একাধিক প্রতিকার প্রার্থনার সুযোগ থাকা এবং বাদী কর্তৃক দায়েরকৃত পারিবারিক মোকদ্দমায় বিবাদীর পাল্টা দাবির (কাউন্টার ক্লেইম) সুযোগের প্রবর্তন করা ইত্যাদি মামলার আধিক্যতা হ্রাসে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। মামলাজট কমাতে, সরকারের আর্থিক অপচয় রোধ করতে, বিচারপ্রার্থীর ভোগান্তি লাঘব করতে, সর্বোপরি বিচারিক সেবা সহজীকরণের নিমিত্তে পারিবারিক আদালতের এখতিয়ার সম্প্রসারণের পাশাপাশি পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার এখন সময়ের দাবি।

আরও পড়ুন

×