ইদানীং মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিভিন্ন দেশের মাথাপিছু জিডিপি সংক্রান্ত পূর্বাভাস প্রকাশের পর থেকে এ আলোচনা বেশ গতি পেয়েছে। আইএমএফের ১৫ অক্টোবর প্রকাশিত পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২০ সালে বাংলাদেশ ভারতের মাথাপিছু জিডিপিকে ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৪ শতাংশ বেড়ে হবে ১৮৮৮ মার্কিন ডলার। করোনার প্রাদুর্ভাবে বিগত দিনগুলোতে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। আর এমন সময়ে আইএমএফ থেকে আসা চমকপ্রদ এ পূর্বাভাস নিঃসন্দেহে আনন্দের, আশাব্যঞ্জক।

মুশকিল হলো, আমাদের এই আশার বিপরীতে অনেক নিরাশার বাণীও বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিমাপের জন্য জিডিপি কতটা কার্যকর পন্থা- হাজির হয়েছে এ প্রশ্ন। ২৬ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিকে জিডিপি নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে দুটি প্রতিবেদন। 'বিশ্ব জিডিপিতে বাংলাদেশের অংশ মাত্র ০ দশমিক ৩৪ শতাংশ'- এরূপ প্রতিবেদনে হতাশা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, 'মাথাপিছু উৎপাদন যাই হোক, মোট দেশজ উৎপাদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে ঢের পেছনে। ২০১৯ সালে ভারতের জিডিপি ছিল ২ দশমিক ৮৮ ট্রিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের ছিল মাত্র দশমিক ৩৩ ট্রিলিয়ন ডলার। আরেক প্রতিবেদনে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, 'জিডিপির আকার বা প্রবৃদ্ধি মানুষের কাছে দুর্বোধ্য।' একই দিন আরেকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ডা. জাহেদ উর রহমান বলেছেন, 'জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে এবং মাথাপিছু জিডিপি নিয়ে বড়াই করার দিন গত হয়েছে বহু আগেই।' তিনি আরও বলেছেন, 'মাথাপিছু জিডিপি দিয়ে একটি দেশের অবস্থান বুঝতে চাওয়া একেবারেই বোকামি।'

তবে কি আমরা সত্যিই বোকার স্বর্গে বাস করছি? দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে জিডিপির কি কোনোই সম্পর্ক নেই? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে একটি দেশের জিডিপি কীভাবে পরিমাপ করে, সেটা জানতে হবে। মোট জাতীয় উৎপাদনও (জিএনপি) জানা দরকার। জিডিপির সঙ্গে জিএনপির পার্থক্য, মানুষে মানুষে আয় বৈষম্যের গিনি সূচক, মুল্য সংযোজন, ক্রয়ক্ষমতার সমতায়ন (পিপিপি) ইত্যাদি পরিমাপক সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকা আবশ্যক। আশার কথা হলো, এসব বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা নেওয়ার জন্য অর্থনীতিতে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার প্রয়োজন নেই। এটা কোনো রকেট সায়েন্সও না। সাধারণ জ্ঞানের বিচার-বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করলেই জিডিপি বোঝা যায়। প্রাথমিক কিছু তথ্য জেনে অর্থনীতির গাণিতিক বা সিমোলেশন মডেল বিশ্নেষণ করা যাবে না। দরকারও নেই। জিডিপির রাজ্যে বোকার হাড্ডি হয়ে বসে আছি কিনা, সেটা বুঝতে পারলেই হলো।

তাত্ত্বিকভাবে জিডিপিকে তিনটি ভিন্ন উপায়ে দেখা হয়। প্রকাশ করা হয় তিনটি ভিন্ন গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে। আইএমএফের সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী 'জিডিপি হলো কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি দেশের মধ্যে উৎপাদিত সব চূড়ান্ত পণ্য এবং পরিষেবার বাজারমূল্য।' এ সংজ্ঞা থেকে আমরা দেখতে পাই (১) জিডিপি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পাদিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের হিসাব। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অর্থবছরের সংজ্ঞা অনুযায়ী ১ জুলাই থেকে ৩০ জুনের মধ্যে সম্পাদিত অর্থনৈতিক কাজের হিসাব হলো বাংলাদেশের জিডিপি। (২) এর একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমা আছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে উৎপাদিত পণ্য এবং আগত অর্থের হিসাবই বাংলাদেশের জিডিপি। (৩) জিডিপি হলো পণ্য ও সেবার হিসাব। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, গাড়ি বানানোর সঙ্গে জড়িত অর্থনীতি হবে 'পণ্য', কিন্তু গাড়ি ধোয়ার সঙ্গে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জড়িত তা যাবে 'পরিষেবা' খাতে। (৪) জিডিপি কেবল 'চূড়ান্ত' পণ্য বা সেবার হিসাব। 'অন্তর্বর্তী' কোনো পণ্যের হিসাব জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয় না। (৫) জিডিপি 'বাজারমূল্যে'র সঙ্গে সংশ্নিষ্ট। বর্তমান বাজারে চূড়ান্ত পণ্যের মূল্যই জিডিপির হিসাবভুক্ত হবে।

জিডিপির গাণিতিক সমীকরণ বিবেচনা করা যাক। কোনো দেশের জিডিপি প্রকাশের জন্য রয়েছে তিনটি ভিন্ন গাণিতিক সমীকরণ। (১) উৎপাদন গণনা পদ্ধতি, (২) আয় নিরূপণ পদ্ধতি এবং (৩) ব্যয় নিরূপণ পদ্ধতি। এই সমীকরণের মাধ্যমে কোনো দেশে এক অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি খাতে সব ব্যয় যোগ করে জিডিপি নিরূপণ করা হয়ে থাকে।

আমরা আগেই জেনেছি, মোট জাতীয় পণ্য (জিএনপি) মোট দেশীয় পণ্য (জিডিপি) থেকে ভিন্ন। একটি দেশের সব নাগরিক যে আয় করে সেটাই জিএনপি। জিডিপি হলো দেশের ভেতরে উৎপাদন, আর জিএনপি হলো দেশের সব নাগরিকের এক অর্থবছরের আয়। সেই নাগরিক বিশ্বের যেখানেই থাক না কেন, সে তার উপার্জিত আয় দেশে পাঠালে তা দেশের জিএনপিতে যুক্ত হবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, জাপানে কর্মরত কোনো বাংলাদেশি শ্রমিকের আয় বাংলাদেশের জিডিপির অংশ না হয়ে জাপানের জিডিপির অংশ হবে। কারণ উক্ত পণ্য বা সেবা উৎপাদন হয়েছে জাপানের অভ্যন্তরে। কিন্তু সে তার উপার্জনের কিছু অংশ বাংলাদেশে পাঠালে তা বাংলাদেশের জিএনপিভুক্ত হবে এবং জাপানের জিএনপির হিসাব থেকে বাদ যাবে। একইভাবে জাপানের কোনো বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশের ইপিজেডে বিনিয়োগ করে পণ্য উৎপাদন করলে উৎপাদনটি বাংলাদেশের জিডিপিতে যুক্ত হবে। কোম্পানির লভ্যাংশ বাংলাদেশের জিএনপি থেকে বাদ গিয়ে জাপানের জিএনপিতে যুক্ত হবে। সহজ ভাষায়, জিডিপি হলো দেশের ভেতরের আয়, আর জিএনপি হলো দেশের নাগরিক কর্তৃক আয়।

বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের জিডিপি ও জিএনপি দুটোই বেড়েছে উল্লেখ্যযোগ্য হারে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২০ মতে, গত এক দশকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশেরও বেশি হারে। ২০১০-১১ অর্থবছরের ৯,১৫,৮২৯ কোটি টাকার জিডিপি বেড়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে হয়েছে ২৭,৯৬,৩৭৮ কোটি টাকা, যা তিন গুণেরও বেশি। এ সময়ে ৯,৮৮,৩৪২ কোটি টাকার জিএনপি বেড়ে হয়েছে ২৯,৩০,৪২৬ কোটি টাকা। এসব দেখেই হয়তো বিশ্বব্যাংক বলতে বাধ্য হচ্ছে, 'টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।' আইএমএফ তারিফ করে বলেছে, বাংলাদেশ চিত্তাকর্ষক অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং সামাজিক বিকাশ অর্জন অব্যাহত রেখেছে।'

যদিও জিডিপি এবং জিএনপি দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নচিত্র তুলে ধরতে অনেকেরই রয়েছে ঘোর আপত্তি। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিনের মতে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্য সংযোজন- এসব দিয়ে মানুষ নিজ দেশের উন্নয়ন বুঝতে পারে না। তার মতে, 'মানুষ তার নিজেদের যাপিত জীবন দিয়েই উন্নয়ন বোঝেন।' তিনি একটি দেশের উন্নয়ন বোঝার জন্য গণপরিবহন, গণশৌচাগার ইত্যাদির অবস্থা সম্পর্কিত নানান দৃশ্যমান সূচক প্রবর্তনের কথা বলেছেন। অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমানের মতে, জিডিপি গণনার সময় শুধু মাথাপিছু গড় আয় হিসাব করা হয়। কিন্তু সবচেয়ে গরিব ৪০ শতাংশের মাথাপিছু আয় কত, তা হিসাব করা হয় না।' এ প্রসঙ্গে জিডিপির প্রচারক নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজনেটসের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। মূলত তিনিই মার্কিন জাতীয় আয়ের পরিমাপ হিসাবে জিডিপি ব্যবহারের প্রচার করেছিলেন ১৯৩০-এর দশকে। সেই থেকেই জিডিপি জনপ্রিয়তা পায়। তার ভাষ্যে জিডিপি হলো, 'অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট পরিমাপের চেয়ে তুলনামূলক নির্ভুল এবং কেবল আনুমানিক পরিমাপের সংমিশ্রণ।'

শতভাগ নির্ভুল না হয়ে 'তুলনামূলক নির্ভুল' হওয়ার জন্যই জিডিপিকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে 'বিতর্কিত আইকন' হিসেবে। আর মূল বিতর্কটি এর মাথাপিছু আয় দিয়ে মানুষে মানুষে বৈষম্য বুঝতে না পারা। ওইসিডি যথার্থই বলেছে, 'জিডিপি আয়ের পরিমাপ করে, তবে সমতা নয়। এটি সামাজিক সংহতি এবং পরিবেশের মতো মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে।' সমাজে আয় বৈষম্য নিরূপণের জন্য ব্যবহূত হয় 'গিনি সূচক'। ইতালীয় পরিসংখ্যানবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী করারাদো গিনি ১৯১২ সালে এ সূচকের অবতারণা করেন। গিনি সূচকের মান হতে পারে শূন্য থেকে ১। কোনো সমাজের সব সম্পদের মালিক একজনই হলে, অন্য কারও হাতে কোনো সম্পদ না থাকলে সে সমাজে হবে চূড়ান্ত বৈষম্য এবং এর গিনি সূচক হবে '১'। বিপরীত দিকে, কোনো সমাজের সব সম্পদ সবার মাঝে শতভাগ সমভাবে বণ্টন হয়ে থাকতে এ সমাজের গিনি সূচক হবে 'শূন্য'।

বাংলাদেশে আয় বৈষম্য কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০০ সালে গিনি সূচক ০ দশমিক ৪৫১ থেকে বেড়ে ২০১৬ সালে হয়েছে ০ দশমিক ৪৮২। বিশ্বব্যাংকের মতে, বৈষম্যের দিক থেকে ২০১৮ সালে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৪০তম। অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আয় বৈষম্যকে বাংলাদেশের আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার ভাষ্যে, 'একটি ব্যাপক ও গভীর বৈষম্যপূর্ণ সমাজে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার টেকসই করা যায় না।' সম্পদের অসম বণ্টন ও ভোগ বৈষম্য কোনো সমাজেই কাঙ্ক্ষিত নয়। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও অর্থনীতিতে আয় বৈষম্য বৃদ্ধির পক্ষেও যুক্তি আছে। আছে গবেষণা। কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্কাস ব্রুকনার এবং বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল লেডারম্যান দেখিয়েছেন, স্বল্প আয়ের দেশে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি দেশের সার্বিক উন্নয়ন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অনেকেই যুক্তি দিয়ে থাকেন, দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতির প্রাথমিক পর্যায়ে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি পায় এবং পরে তা কাঙ্ক্ষিত স্থিতাবস্থায় ফিরে আসে।

বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতির সবচেয়ে বড় ভক্ত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। নারীর ক্ষমতায়ন, গড় আয়ু বৃদ্ধি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি ইত্যাদি সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে বিশ্ব ফোরামে বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকেন তিনি। ২০২০ সালে ১৮৭৭ মার্কিন ডলার মাথাপিছু আয় নিয়ে ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়ার রোমাঞ্চকর ঘটনাটি বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে একটি দুর্দান্ত অর্জন। আমাদের আরও ভালো করতে হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্নের পথে আমাদের মাথাপিছু অর্জন হতে হবে ১২,৫০০ মার্কিন ডলার। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা অর্জনের পথে পাড়ি দিতে হবে হাজার মাইল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগোচ্ছে সে পথেই।