- চতুরঙ্গ
- পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু : 'ভাগ্য' নয়, 'দুর্ঘটনা'
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু : 'ভাগ্য' নয়, 'দুর্ঘটনা'

'এক দিন সকাল আনুমানিক ১১টার দিকে হঠাৎ খেয়াল হলো যে, অনেক্ষণ যাবৎ আমার মেয়েটাকে দেখছি না। অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম। বাড়ির সবাই এমনকি পাড়ার লোকেরাও সারা পাড়ায় খুঁজল। হঠাৎ একজন এসে চিৎকার করে জানাল, আমার মেয়েটা পুকুরের এক কোনায় পানির মধ্যে ভুট (উপুড়) হয়ে পড়ে আছে। বিশ্বাস করেন হাঁটুসমান পানি হবে সেখানে। অথচ আমার মেয়েটা সেখানে পড়েই মরে গেল। আল্লাহ আমার মেয়েটাকে নিয়ে গেল। এতটুকু ভাগ্য নিয়ে সে দুনিয়াতে এসেছিল।' এভাবেই জাহানারা বেগম (২৮) কাঁদতে কাঁদতে তার মেয়ের অকাল মৃত্যুর স্মৃতি বর্ণনা করছিলেন।
বাংলাদেশ ইনজুরি সার্ভের (২০১৬) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪০টি শিশু এবং বছরে ১৪ হাজার ৪৩৮টি শিশুর জীবনের ইতি ঘটে পানিতে ডুবে। এই সংখ্যা দেশের প্রায় সাতটি গ্রামের মোট জনসংখ্যার সমান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার হার অন্যান্য স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি। দেশে এক থেকে চার বছর বয়সের মধ্যে মারা যাওয়া শিশুদের ৪৩ ভাগ মারা যায় পানিতে ডুবে। উন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপের কারণে এই হার কমলেও বৈশ্বিকভাবে এটি এখনও ভয়ংকর এক ঘাতক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সারা পৃথিবীতে এক বছরে ৩৬০,০০০ মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এটি অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনাজনিত মোট মৃত্যুর মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ কারণও।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি বরিশাল বিভাগে। একটি প্রকল্পের প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ অঞ্চলে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার হার প্রতি লাখে ৩৭.৯ জন, যা সারাদেশে প্রতি লাখে ১১.৭ জন। এই অঞ্চলে নদী-নালা বেশি হওয়ার কারণে এই হার বেশি হতে পারে। তবে যেসব অঞ্চলে নদী-নালা কম, সেসব অঞ্চলেও পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার অনেক বেশি। বাংলাদেশে প্রায় ১.৩ মিলিয়ন পুকুর রয়েছে যার অধিকাংশই উন্মুক্ত এবং ঘরবাড়ির আশপাশে অবস্থিত। ফলে যখন মায়েরা দিনের প্রথম প্রহরে ব্যস্ত থাকেন এবং শিশুদের দেখাশোনা করার কেউ থাকে না, এমন সময়ে শিশুরা বড়দের চোখের আড়াল হয়ে যায় এবং বাড়ির আশপাশের এসব পুকুর বা জলাশয়ে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেমনটি ঘটেছে ওপরে উল্লিখিত জাহানারা বেগমের সন্তানের বেলায়।
একটি জাতীয় জরিপে দেখা যায়, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ডুবে যাওয়া ঘটনাগুলোর ৮০ ভাগই ঘটেছে বাড়ি থেকে মাত্র ২০ মিটার দূরত্বের মধ্যে। এই শিশুদের অধিকাংশই ডুবে গেছে পুকুর এবং জলাশয়ে। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় সাধারণত মায়েরা বা পরিবারের নারী সদস্যরা শিশুদের দেখভাল করে থাকেন। গবেষণায় দেখা যায়, শিশু ডুবে যাওয়ার ৬৮ ভাগ ঘটনা ঘটে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে অর্থাৎ, যে সময়টাতে মায়েরা সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন, সে সময়ে শিশু ডুবে যাওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে থাকে।
বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছিল যা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসনীয় হয়েছে। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন (এসডিজি) অর্জনের পথেও আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি করছে বলে দাবি করা হয়। বিশেষ করে, দারিদ্র্য বিমোচন, মাতৃমৃত্যু এবং শিশু মৃত্যু হ্রাস, প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, মাধ্যমিক শিক্ষায় লিঙ্গীয় সমতা প্রতিষ্ঠাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে এই সফলতা লক্ষণীয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়েও ভালো অবস্থায় পৌঁছেছে। তবে শিশুদের সুরক্ষা, শিশু স্বাস্থ্য এবং শিশু বিকাশের মতো বিষয়গুলোতে এখনও বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এর মধ্যে পানিতে ডুবে শিশুদের মৃত্যুর ঘটনা অন্যতম।
ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশে সংস্কৃতির সঙ্গে নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল এবং পুকুরের সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে বিশেষ করে 'গেরস্থ' পরিবারের অন্যতম আভিজাত্যের প্রতীক হচ্ছে 'গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ এবং গোয়াল ভরা গরু'। ঐতিহাসিকভাবে পুকুর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মৎস্য সম্পদের অন্যতম উৎস। তবে শুধু মৎস্য সম্পদের জন্যই নয় বরং এলাকার মানুষের নিত্যদিনের ব্যবহার্য পানির চাহিদাও মেটায় পুকুরগুলো। এ ছাড়া নলকূপ সহজলভ্য হওয়ার আগে মানুষ পুকুরের পানিই পান করত।
তবে এসব পুকুর ও জলাশয় উন্মুক্ত থাকায় শিশুদের ডুবে যাওয়ার ঘটনা নিয়মিতই ঘটে থাকে। কেউ পানিতে ডুবে গেলে সাধারণত তিন ধরনের ফলাফলের সম্ভাবনা থাকে- মৃত্যু, অসুস্থ হয়ে যাওয়া অথবা অসুস্থ না হওয়া। তবে সাধারণ মানুষের মাঝে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডুবে যাওয়াকে কোনো ধরনের ইনজুরি বা ইনজুরিজনিত মৃত্যু বা প্রতিরোধ করা যায় এমন দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না বরং 'নিয়তি' হিসেবেই দেখা হয়। উপরে উল্লিখিত ঘটনার মতো বিশ্বাস করে নেওয়া হয় যে, এখানে মানুষের কিছুই করার নেই বরং সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমন বিশ্বাসের কারণে সাধারণ মানুষের কাছে ডুবে যাওয়াকে প্রতিরোধযোগ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা এবং পদক্ষেপ নেওয়ার উদাহরণ তেমন একটা দেখা যায় না।
বিভিন্ন সময়ে টিভি অনুষ্ঠান ও পাঠ্যবইয়ে ডুবে গেলে উদ্ধারের পর কী করণীয় সে বিষয়ে পরামর্শমূলক আলোচনা হলেও কীভাবে ডুবে যাওয়া রোধ করা যায়, সে বিষয়ে খুব বেশি উপাদান দেখা যায়নি। আবার কিছু ক্ষেত্রে ভুল কৌশল শিক্ষা দেওয়া হয় বলেও জানা যায়।
যাই হোক, ব্লুমবার্গ ফিলান্থপিসের আর্থিক সহায়তায় এবং জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধায়নে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের ডুবে যাওয়া প্রতিরোধে এলাকাভিত্তিক শিশু যত্নকেন্দ্র অত্যন্ত কার্যকর একটি মাধ্যম হতে পারে। কয়েকটি জেলায় 'আঁচল' নামক এলাকাভিত্তিক যত্নকেন্দ্র বাস্তবায়নের মাধ্যমে তারা দেখায় যে, যেসব শিশু এসব যত্নকেন্দ্রে অংশগ্রহণ করে তাদের ক্ষেত্রে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা অন্য শিশুদের তুলনায় ৮০% কম। পাশাপাশি শিশুদের নিরাপদ সাঁতার শেখানোর জন্য সুইমসেফ নামক উদ্যোগও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
সম্প্রতি ড্রাউনিং প্রিভেনশন পার্টনারশিপ-সিনারগসের আর্থিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ (বিআইএসআর) কর্তৃক পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, আঁচল কেন্দ্রে এক থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের যথাযথ তত্ত্বাবধায়নের মধ্যে রাখার পাশাপাশি শিশুর যত্ন এবং বিকাশ (ইসিসিডি) সেবাগুলোও প্রদান করা হচ্ছে। যেমন- রেবা (৩২) নামে একজন মা বলেন, 'আমার বাচ্চার বয়স দুই বছর। তার বাবা সারাদিন বাইরে থাকে। আমার শাশুড়িও বৃদ্ধ, চলতে পারেন না। ফলে আমি যখন ব্যস্ত থাকি বিশেষ করে সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে যখন রান্না এবং ঘরের কাজ গোছানোর চাপ থাকে তখন বাচ্চাটিকে দেখে রাখা কঠিন হয়ে যায়। এলাকায় আঁচল স্কুল হওয়ার পর আমি সেখানেই রাখি। সে নিরাপদে থাকে এবং সঙ্গে সুন্দর সুন্দর ছড়া, গান, নাচ এবং বর্ণমালাও শিখতে পারে।'
এ ছাড়া ছয় থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুরা সুইমসেফে অংশ নিয়ে সাঁতার শিখতে পারে। নিরাপদ সাঁতারের কৌশল শেখার মাধ্যমে তারা নিজেদের ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। নুরনবী (৬৫) নামে একজন তথ্যদাতা বলছিলেন :'যখন প্রকল্প থেকে আমার নাতিকে সাঁতার শেখানোর ব্যাপারে বলল, তখন আমি হেসেই উড়িয়ে দিলাম। আমি ভাবলাম আমাদের তো কেউ সাঁতার শেখায়নি। এটা তো আমরা এমনিতেই শিখি। কিন্তু এক দিন তাদের একটি বৈঠকে গিয়ে আমার চোখ খুলল। আমি দেখলাম সুন্দর কৌশলের মাধ্যমে মাত্র কয়েক দিনেই সাঁতার শেখা যায়। আমি ভাবলাম স্বাভাবিকভাবে শেখার আগেই তো আল্লাহ না করুক আমার নাতির একটি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য আমি তাকে সাঁতার শেখার জন্য পাঠালাম। সেখান থেকে মাত্র এক সপ্তাহে সে সাঁতার শিখেছে।'
বিআইএসআরের গবেষণায় আর দেখা যায়, শিশুদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ করে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য অভিভাবকদের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি এবং বিষয়টি ওই প্রকল্পে গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অভিভাবক সভা, মাসিক বৈঠকসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এলাকার মানুষকেও এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই প্রকল্পটি স্বল্পমেয়াদি হলেও উপকারভোগী মানুষের শতভাগই প্রত্যাশা করে, এটি তাদের এলাকায় দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকুক। এর জন্য প্রয়োজনে তারা আর্থিক এবং অন্যান্য সহযোগিতা করারও ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।
শিশুদের ডুবে যাওয়া প্রতিরোধে এমন উদ্যোগ সারাদেশে বাস্তবায়ন করা হলে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমবে বলে গবেষণায় দেখা যায়। বলা হয়ে থাকে, 'শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ', কিন্তু শুধু পানিতে ডুবেই যদি এত শিশু মারা যায় তাহলে দেশ হারাবে তার সম্ভাবনাময় সম্পদ। এজন্য সরকারের কার্যকর উদ্যোগ এবং ওই বিষয়ে অভিজ্ঞ বেসরকারি সংস্থাগুলোর যৌথ এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করা যেতে পারে শিশুদের জীবন। এটি একটি পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত কৌশল, যা কেবল বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগের প্রয়োজন।
মন্তব্য করুন