একাত্তরে জীবন বাজি রেখে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের গুলির আঘাতে হয়েছি যুদ্ধাহত। বয়স এখন সত্তরের কোটায়। জীবন সায়াহ্নে এসে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মেলাতে পারছি না। সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় দেশমাতৃকার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ চলাকালে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকারের অপরাধের সাক্ষ্য দিয়েছি। ৮নং সেক্টরে গ্রুপ কমান্ডার আব্দুল হামিদের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দিন লাখো মানুষের মাঝে আমিও ছিলাম। তার বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাকে রক্তে আগুন জ্বলতে থাকে। সেদিনের ভাষণ শেষে ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে যাই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে তার নির্দেশনা জানতে। এরই মধ্যে ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর ঢাকা আক্রমণে তছনছ হয়ে যায় সবকিছু। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে জীবন বাঁচাতে ঢাকা শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করে হাজারো নিরীহ মানুষ। ওই রাতে রাজধানীর ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত গিয়ে ময়লা-আবর্জনার স্তূপের কাছে আটকে যাই। সেনাবাহিনীর হামলার ভয়ে দুর্গন্ধের মধ্যেই রাত কাটে। ঢাকা থেকে বের হবার সকল প্রধান সড়কে সেনা টহল। যারাই পালানোর চেষ্টা করেছে তাদেরই নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলছে তারা। মৃত্যুর ভয়ে দুই দিন দুই রাত ওই বর্জ্যের মধ্যে কাটিয়ে ক্ষুধার জ্বালায় শেষে পালিয়ে লোকালয়, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে সোয়ারী ঘাটে পৌঁছাই। সেখান থেকে পদ্মা নদী পার হয়ে নারার ট্যাক, সেখান থেকে আবার হাঁটতে হাঁটতে ফরিদপুর পৌঁছতে মোট দুই দিন লেগে যায়।

ফরিদপুরে ফিরে আমরা স্বাধীনতাকামী তরুণরা সংগঠিত হতে থাকি। আমি, বাবুনাথ, আমার ভাই আমীর, কুদ্দুসসহ যারা প্রাণে বেঁচে ঢাকা থেকে ফিরেছিলাম তারাসহ আরও অনেককে সঙ্গে নিয়ে ২০ এপ্রিল গোয়ালন্দ ঘাটে প্রতিরোধ যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিই। শহরের জামান সাহেবের পাম্প থেকে ট্রাকে করে ড্রামে পেট্রোল ভরে গোয়ালন্দ যাই। সেখানে ফেরি ও জাহাজ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের শেলিং করে, আমাদের ট্রাক ও তেলের ড্রাম জ্বালিয়ে দেয়। বাধ্য হয়ে আমরা পিছু হটে চলে আসি। ২১ এপ্রিল ফরিদপুর শহরে আর্মি প্রবেশ করে এবং শ্রীঅঙ্গনসহ বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগ করে। মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের সহায়তায় চালায় লুটতরাজ। আমাকেসহ কয়েকজনকে ওই দিনই আর্মি তাদের জিপে করে তুলে নিয়ে যায় সার্কিট হাউসে। ঘণ্টাখানেক পরে মেজর আকরাম কোরেশী এলো, সঙ্গে ফরিদপুরের মুসা বিন শমসের। আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তাল গাছের নিচে বসিয়ে রাখে। বিহারি এক যুবক এসে আমাদের বেধড়ক মারধর করে। বিকেলে বালুচ এক অফিসারের দয়ায় আমাদের গোপনে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ফিরে গিয়ে দেখি বাড়িঘর কিছুই নেই। সব কিছু লুটপাট হয়ে গেছে।

সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম ভারত গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেবার। ফরিদপুর থেকে প্রথমে নগরকান্দা যাই, তারপর প্রস্তুতি নিয়ে হেটে ভারতের বর্ডারের দিকে যাত্র শুরু করি। ভারতে গিয়ে দেখি সেখানে তখনও ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ শুরু হয়নি। মেজর জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। আমাদের সঙ্গে মাত্র ২টি অস্ত্র ও ২টি গ্রেনেড ছিল। যশোরের আড়পাড়া দিয়ে আমরা দেশে ফিরে যুদ্ধে নামার চেষ্টা করি। যশোরের ৩টি ছেলে আমাদের সঙ্গে ছিল। লুৎফর, মনসুর এবং আরও একজন। ওদের তিনজনের কাছে তিনটি অস্ত্র ছিল। ওদের বললাম, আমাদের আড়পাড়া এলাকাটা পার করে দেবার জন্য। আমরা পার হবার সময় রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলি হয়। আমার সঙ্গী হানিফের পায়ে গুলি লাগে, আমার পিঠে এক জায়গায় গুলি ঢুকে আরেক জায়গা দিয়ে বের হয়ে যায়। আড়ংখালী এলাকায় চান্দ্রা হাইস্কুলের কাছে আমার এক আত্মীয় বাড়িতে আহত অবস্থায় আশ্রয় নিই। কিছুটা সুস্থ হয়ে কয়েক দিন পর ২৭ জুলাই সেখান থেকে ফেরার পথে রাজাকাররা আবার আমাকে ধরিয়ে দেয়। তারপর এক মাস ৯ দিন ফরিদপুর স্টেডিয়ামের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আমাকে আটকে রেখে নির্যাতন করে পাকিস্তানি আর্মি। আমার ভাই আমিরও আটক ছিল ১৮ দিন। আগস্ট মাসের শেষের দিকে বন্দি মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অনেককে গুলি করে মেরে ফেলতে শুরু করল। একদিন রাতে পাংশার মনসুর আর পশ্চিম খাবাসপুরের শামসু মিলে প্ল্যান করল ক্যাম্পের ভেতরে তেলের ড্রামে আগুন দিয়ে আমরা পালিয়ে বের হয়ে যাব। ছক অনুযায়ী সেই ঘটনা ঘটিয়ে আমরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হই।

বর্তমানে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারের ভাতা পাচ্ছি। কিন্তু দেশের হাজারো মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের চাকরি হলেও আমার ৬ সন্তানের সকলেরই সরকারি চাকরির বয়স চলে গেছে। শতচেষ্টা করেও তাদের জোটেনি কর্ম সংস্থানের একটু সুযোগ। সারা জীবনের প্রচেষ্টায়ও গড়তে পারেননি নিজের জন্য একটি পাকা বাড়ি। সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ভাতার টাকায় তার চিকিৎসার ব্যয়টুকুও সম্পন্ন হয় না।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা


অনুলিখন :: হাসানউজ্জামান নিজস্ব প্রতিবেদক, ফরিদপুর।