বিশ্ব মানচিত্রে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এক রাষ্ট্র বাংলাদেশ। যার জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। দীর্ঘ তেইশ বছরের শোষণ, নিপীড়ন ও সীমাহীন অত্যাচার সহ্য করে বাংলার মুক্তিকামী জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশমাতৃকার স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে। নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যাবতীয় দম্ভ চূর্ণ করেছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই রাতেই ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করে পাকিস্তানি হায়েনার দল। শুরু হয় সশস্ত্র। অবশেষে ৩০ লাখ শহীদের পবিত্র রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সল্ফ্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়; অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশের পরিচিতি ঘটে। প্রতিটি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে রয়েছে শত-সহস্র ঝড়-ঝাপটা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই নীতির ব্যতিক্রম হয়নি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। খাদ্য সংকট, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, অবকাঠামোগত অসুবিধা ইত্যাদি নানা দিক থেকেই বাংলাদেশের অবস্থা হয়ে পড়ে করুণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মানুষ অবকাঠামোগত উন্নয়নে এগিয়ে আসে। সেই থেকে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার শুরু।

বর্তমানে শেখ হাসিনার সরকার টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা উন্নত বিশ্বের যেকোনো দেশের কাছেই ঈর্ষার কারণ। একটি দেশ স্বল্পোন্নত (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য শর্ত হলো- মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক- এই তিনটি সূচকের যেকোনো দুটি অর্জন করা। বাংলাদেশ এই তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উত্তীর্ণ হয়েছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের মানদণ্ড অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তার থেকে অনেক বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় দাঁড়িয়েছে ২০৬৪ মার্কিন ডলার। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৯০৯ মার্কিন ডলার। এক বছরের ব্যবধানে দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় বেড়েছে ১৫৫ ডলার। এটা কি আমাদের জন্য আশার বাণী নয়?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেন সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি বদ্ধপরিকর। এরই অংশ হিসেবে দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির সেবা পৌঁছে দিতে দেশের ৪ হাজার ৫৫৫টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত এ পোর্টালের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। দেশের সবক'টি উপজেলাই ইন্টারনেটের আওতাধীন। টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ফলে বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি, যাদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। ইসেবা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ প্রশংসার দাবি রাখে। কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ, এমনকি ব্যাংকিং কার্যক্রম এখন ঘরে বসেই অতি অল্প সময়ের মধ্যে করা সম্ভব হচ্ছে। কৃষি খাতে অভূতপূর্ব উন্নতির কারণে দেশের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে উজ্জ্বল হচ্ছে। প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার এ দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও এই বাংলার খাদ্য রপ্তানি করা হচ্ছে। আয় হচ্ছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। বিগত বছরগুলোতে ধানের উৎপাদন বেড়েছে ৫০ লাখ টন। বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে রয়েছে জাতীয় গ্রিডে অতিরিক্ত ৬ হাজার ৩২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংযোজন। দেশের প্রায় ৯৪ শতাংশ মানুষ এখন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতাধীন। কয়েক বছরের হিসাব করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুতে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৩ বছর। শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার হার এখন মাত্র ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ। যার ফলে মানুষ এখন আগের চেয়ে তাদের সন্তানকে উচ্চশিক্ষার দিকে উৎসাহ দিচ্ছে। সরকার বিনামূল্যে বই বিতরণ করছে, মেয়েদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করছে; যার দরুন শিক্ষা খাতে বিপ্লবের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ।

স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে উপজেলা এবং জেলা শহরে সরকারি হাসপাতাল নির্মাণ এবং হাসপাতালের শয্যা বর্ধিতকরণ সরকারের উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ। তবে স্বাস্থ্য খাত এবার অন্য সব খাত থেকেই একটু ব্যতিক্রম। মহামারি করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) কারণে মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই লকডাউন মেনে চলেছে। পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ রয়েছে গত ১৮ মার্চ থেকে। এ অবস্থায় সরকারের গৃহীত নীতি বাংলাদেশের মানুষকে আশার বাণী শুনিয়েছে। করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রভাব থেকে উত্তরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত এপ্রিল মাসেই ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেন। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন ১৫ লাখ ৩৭ হাজার ৭৫৩ জন। বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৬৮৩৮। যদিও জাতিসংঘ ধারণা করেছিল, বাংলাদেশে দুই মিলিয়ন মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারেন।

সেই হিসাবে আমাদের ক্ষতি খুব একটা বেশি নয়। পরিশেষে বলা যায়, ক্ষুদ্র আয়তনের একটি দেশ হয়েও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উন্নয়ন ও অগ্রগতির নানা সূচকে সাফল্যের ধারা অব্যাহত রেখে সারা বিশ্বের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। 

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, বৈশ্বিক মহামারি, দারিদ্র্য দূরীকরণে যথাযথ ভূমিকা, বৃক্ষরোপণ ছাড়াও বিশেষত শিক্ষা সুবিধা, নারীর ক্ষমতায়ন, শতভাগ বিদ্যুৎ সংযোগ, উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাস করা, দরিদ্র মানুষের জন্য স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করা- প্রভৃতি জনহিতকর কার্যক্রমের জন্য বর্তমান বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে এক অনন্য নজির হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিষয় : বাংলাদেশের অর্জন

মন্তব্য করুন