আমি যাই যতদূর, আমার দেশ যায় ততদূর। মানচিত্র আর সীমারেখায় আবদ্ধ থাকে না কারও স্বদেশ। শুধু পণ্য নয়, মানুষও দেশের বাহক হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। মেইড ইন বাংলাদেশ লেখাটি পোশাকের গায়ে প্রায়ই দেখে থাকেন নিউইয়র্কের অধিবাসীরা। আস্থাও রাখেন বাংলাদেশি পোশাকের ওপর। বাংলাদেশিরা যখন নানাভাবে ছড়িয়ে থাকেন নিউইয়র্কে তখন ভিনদেশি সব মানুষ আপনাকেই বাংলাদেশ হিসেবে জানে। 

নিউইয়র্ক শহরের ফাইভ বরোতে প্রায় ২ লাখের মতো নিবন্ধিত এবং ৫০ হাজারের মতো অনিবন্ধিত বাংলাদেশি তো কম সেবা দিচ্ছে না এই শহরের বাসিন্দাদের। তারপরেও কে খবর রাখে বাংলাদেশি সংগ্রামী ও পরিশ্রমী মানুষদের? নিউইয়র্কের কুইন্স, দ্য ব্রঙ্কস এবং ব্রুকলিনের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বাংলাদেশিরা এমনভাবে বসবাস ও চলাফেরা করেন দেখে মনে হয় এ যেন নিউইয়র্কের বুকে ক্ষুদ্র বাংলাদেশ।

আমেরিকার উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছে স্বতন্ত্র সংস্কৃতির এই মানুষজন। এই রাষ্ট্রে বাংলাদেশিদের দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তানরা বেড়ে উঠছে। তাদের বেশিরভাগই এখন কায়িক পরিশ্রমের পরিবর্তে মেধা দিয়ে আমেরিকার উন্নয়নে অংশ নিচ্ছে। মুক্তিকামী মানুষ যখন স্বাধীনতার স্বাদ পায় তখন সে বোঝে প্রকৃত মুক্তির মর্মার্থ। এজন্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমেরিকার আপামর জনতা একাত্মতা ঘোষণা করেছিল। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশটির জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমেরিকার সাধারণ মানুষ এবং বিটলস গায়ক জর্জ হ্যারিসন ও ২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া কবি, গীতিকার ও গায়ক বব ডিলানের সহযোগিতা।

প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে যে নিউইয়র্কার ফাস্ট ফুড থেকে চা-কফি অথবা নাশতা করেন তাতে কোনো না কোনো বাংলাদেশি মানুষের মমতা মিশে থাকে। কারও কারও যত্ন ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে কেউ কেউ জিজ্ঞাসাও করেন আপনি কোন দেশের? অনেকে নাম শুনে চিনতেও পারেন না বাংলাদেশকে। তবু বাংলাদেশ নামটি জমা হয়ে থাকে তার বাম অলিন্দে। বাদামি গায়ের রঙের মাঝারি উচ্চতা ও গড়নের সেই নারী অথবা পুরুষ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে ঝড়-বাদল-তুষারে খাবার পৌঁছে দেন মানুষের ঘরে। অতিথিপরায়ণতা বাংলাদেশি মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে রাত-দিন অন্তত ৩০ হাজার মানুষ নিউইয়র্কারদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত।

হলুদ রঙের ট্যাপি ক্যাব নাকি নিউইয়র্কের অন্যতম পরিচায়ক। সুলভ মূল্যের ট্যাপি-লিমুজিন এবং উবার জাতীয় যানবাহন ছাড়া এই শহরে যাতায়াত অসম্ভব। কেউ যখন মাতাল হয়ে অথবা অন্য যেকোনো সমস্যায় নিজের গাড়ি অথবা সাবওয়ের গাড়িতে চড়ার সুযোগ থাকে না তখন তারাই আপনার একমাত্র অবলম্বন। আপনার একটি কল অথবা হাতের ইশারায় এই টিএলসি চালকরা আপনাকে সযতনে গন্তব্যে পৌঁছে দেন। এই শহরের ট্যাপিচালকের প্রায় ৪৫ শতাংশই বাংলাদেশি। তাদের বিনয়ী আর সহযোগিতামূলক আচরণের প্রভাব কি বাংলাদেশি পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর পড়ে না?

নির্মাণ এবং আবাসন এই শহরের কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ তা ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। শহরের নানান রাস্তায় প্রতিনিয়ত ঘর-অফিস নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণে এবং এ সব স্থাপনা ভাড়া দেওয়া এবং নেওয়াতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন অন্তত বিশ হাজার বাংলাদেশি। নিউইয়র্ক শহরে যানজট নিয়ন্ত্রণে নিরলস পরিশ্রম করছেন অন্তত ৩ হাজার বাংলাদেশি ট্রাফিক এজেন্ট। এর মধ্যে কেউ কেউ সুপারভাইজার, ম্যানেজার ও টিটেকটিভও হয়েছেন প্রমোশন পেয়ে। শহরের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এনওয়াইপিডিতে সাহসিকতার সঙ্গে ভূমিকা রাখছেন প্রায় চারশ বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে রয়েছেন ৩ জন ক্যাপ্টেন, ১৫ জন লেফটেন্যান্ট ও ২৮ জন সার্জেন্ট। বোর্ড অব এডুকেশনে কাজ করছেন প্রায় হাজারখানেক নারী-পুরুষ। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকও আছেন গুটিকয়েক। সিভিল সার্ভিস ও এমটিএতে আছেন আরও হাজারখানেক বাংলাদেশি। নগরীর চিকিৎসা খাতে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন প্রায় হাজারো বাংলাদেশি স্বাস্থ্যকর্মী। তার মধ্যে নিয়মিত রোগী দেখেন অথবা কোনো হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত আছেন অন্তত ৩শ' চিকিৎসক।

ওপরের সংখ্যার তথ্য নেওয়া হয়েছে পিউ রিচার্স এবং সংশ্নিষ্ট পেশাজীবী বাংলাদেশি সংগঠন থেকে। ক্ষুদ্র এই জনগোষ্ঠীর অন্তত হাজারখানেক সংগঠন আছে। তাদের কেউ আঞ্চলিক সমিতি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক। এসব সংগঠনের মাধ্যমে মূলত তারা পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং আড্ডায় মেতে ওঠেন।

মূলত অর্থ উপার্জনের জন্য এই দেশে এলেও অন্তরে ও আচরণে তারা ধারণ করেন পুরো বাংলাদেশকে। পৃথিবীর ইতিহাসে মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানিদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন বাংলাদেশিরা। ইউনেস্কোর স্বীকৃতিতে ১৯৯৭ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে নিউইয়র্কের বাংলাদেশিরাও শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করেন দিবসটি। বাংলা একাডেমির আদলে ৩০ বছর ধরে বইমেলার আয়োজন করে আসছে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন। পরম মততায় তারা উদযাপন করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ সকল জাতীয় দিবসকে।

বাংলা পঞ্জিকার প্রথম দিনে অথাৎ পহেলা বৈশাখে নিউইয়র্কের রাস্তায় বর্ণিল পোশাক পরে হাতে পেঁচা, ঘুড়ি, হাতি, ঘোড়া, লাঙল জোয়ালসহ নানান ধরনের মুখোশ এবং দেশীয় ঐতিহ্যবাহী উপাদান নিয়ে র‌্যালি করে বাংলাদেশিরা। পরিবেশন করা হয় সাদা ভাত ও মাছ-সবজি তরকারি। সঙ্গে নানা ধরনের ভর্তা ও ডাল।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে বিটলস গায়ক জর্জ হ্যারিসন ও বব ডিলান ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের 'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' নামের সংগীতানুষ্ঠানে বিনা পয়সায় গেয়েছিলেন। বিটলসের ড্রামার রিঙ্গো স্টার রাজি হয়েছিলেন হ্যারিসনের কথায়। জনপ্রিয় গায়ক লিওন রাসেল ও বিল প্রেস্টন প্রথম প্রস্তাবেই সম্মতি জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরি ও শরণার্থীদের সাহায্যে তহবিল গঠনে তা ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিল। সত্যিকার অর্থে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার বিরুদ্ধে আর মানবিকতার সপক্ষে যে বড় বড় সংগীতানুষ্ঠান এখন হয়ে থাকে তা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের সমর্থনে সেই 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' থেকেই। এটি আয়োজন করেছিলেন বিশ্বশ্রেষ্ঠ সেতারবাদক রবিশঙ্কর। জর্জ হ্যারিসনের বই 'আই-মি-মাইন' থেকে জানা যায়, অনুষ্ঠানের আগে সব শিল্পীর পুরো রিহার্সালও হয়নি। 

অনুষ্ঠানের আলোর ব্যবস্থা ভালো ছিল না। তথ্যচিত্র ধারণের ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত ছিল না। এরপরও অনুষ্ঠানটি এক দিনে দুবার হয়েছিল। কারণ, প্রথম শো'র সব টিকিট দ্রুতই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।