- চতুরঙ্গ
- বাংলাদেশে সবকিছু হারিয়ে যায়নি, বিশ্বাস মোদি সরকারের
বাংলাদেশে সবকিছু হারিয়ে যায়নি, বিশ্বাস মোদি সরকারের

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি দ্য প্রিন্ট
কয়েকদিন হয়েছে পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান বসেছে, যা নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। সেতুটির মূল অবকাঠামো নির্মাণে কাজ করছে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি। অর্থাৎ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্পটির পেছনে আছে চীন। এমন মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষ স্মরণে ১৭ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় ভার্চুয়ালি এ বৈঠক হওয়ার কথা।
পদ্মার এপার-ওপার ছুঁয়েছে সেতু। এটি বিশাল ব্যাপার। বাংলাদেশিদের জন্য এক স্মরণীয় দিন। স্বপ্ন বাস্তবায়নে অনেক দূর এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এমনকি বাংলাদেশে যারা সরকারের সমালোচনা করেন, তাদের কাছেও এটি বিশাল অর্জন। তাদের মতে, পদ্মা সেতু ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, বাংলাদেশের জন্মে যার অবদান তুলনাহীন। একইভাবে শেখ হাসিনারও স্বপ্ন ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণের। বাবার স্বপ্ন পূরণে তিনিই সেতুটি বাস্তবে রূপদানের মূল কারিগর। এটি নির্মাণে তার সংকল্প ছিল- যেজন্য অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠেছেন তিনি। সেই সাহসও ছিল তার।
পদ্মা নদীর উপর ব্রিজ
বিভিন্ন কারণে পদ্মা সেতুর অনেক কথা। অর্থাৎ এটি একটি গল্প। বিভিন্ন উপায়ে হয়েছে দুই স্তরের ইস্পাতের এই সেতু। যার উপরের স্তরে চারলেনের সড়কপথ। আর নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ। মোটকথা এটি নির্ধারণ করে চীন কীভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবেশের পথে এগিয়েছে- বাংলাদেশে সেটি আরও স্পষ্ট, যেখানে ভারত কয়েক বছর ধরে সম্পর্ক জোরদারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এটি প্রতিবেশীর সঙ্গে গভীর সম্পর্কের বিষয়। খুব বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিল ভারত, কারণ বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জনে ভারত সহায়তা করেছে।
বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জের মাওয়া থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা পর্যন্ত ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ হলে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ তৈরি হবে। এ প্রয়োজনীয়তা থেকে সেতুটি নির্মাণে বাংলাদেশের জোর তৎপরতা। এর মধ্যে ২০১১ সালের দিকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং পদ্মা সেতু নির্মাণে সহায়তায় এক বিলিয়ন ডলার ঋণ ঘোষণা করেছিলেন। আর বাকি তিন বিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের। অবশ্য বাংলাদেশ সেই অর্থ ঋণ নিতে চেয়েছিল আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থার কাছ থেকে।
কিন্তু বিশ্বব্যাংক, এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) ধারণা ছিল ভিন্ন। ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংক হঠাৎ করে প্রকল্পটিতে দুর্নীতির অভিযোগ আনে। পরে তাদের ‘দাম্ভিকতা’ ও ‘প্রতিক্রিয়া’ দেখে শেখ হাসিনা ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেদের আবেদন প্রত্যাহার করে নেন। দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি তার ‘আত্মসম্মানে’ লেগেছিল খুব। এ অবস্থায় তিনি ভেবে থাকতে পারেন, চাওয়ার মানসিকতা পাল্টাতে হবে। ঋণের ভরসা ছেড়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুতে নির্মাণে হাত দেন তিনি। শেখ হাসিনা এ কাজে বন্ধু দেশগুলোকে স্মরণ করেন।
২০১৫ সালের জুনে যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর করেন, তখনও ভারত প্রকল্পটিতে তার সেই ঋণ পরিকল্পনা সেভাবে বাড়াতে পারেনি। দিল্লি ২০০ মিলিয়ন ডলার অনুদান ঘোষণা করেছিল এবং প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে আরও দুই বিলিয়ন ডলার ঋণের কথা বলেছিল, যা প্রকল্পটির জন্য যথেষ্ট ছিল না।
এর মধ্যে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি টেন্ডার জিতে নেয় এবং ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সেতুটির কাজ শুরু করে। এরপর ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রথমবারের মতো ঢাকা সফর করেন, যা ছিল ৩০ বছরের মধ্যে চীনের কোনো প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর। শি জিনপিং ঢাকায় বসে ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি করেন। পরে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ৪২ স্প্যানের সেতুটির ৩৭ এবং ৩৮ নম্বর পিলারে বসে প্রথম স্প্যান।
নতুন সেতু নির্মাণের সময়
একটি সেতু কোনো দেশের সম্পর্ক তৈরি করতে বা ভেঙে দিতে পারে না। এছাড়া অন্যান্য সংযোগ প্রকল্পে ঠিকই ভারত বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। চিলাহাটি-হলদিবাড়ী থেকে একটি রেল রুট পুনর্নির্মাণে মোদি সরকার কাজ করেছে। ১৭ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির শীর্ষ বৈঠকে উদ্বোধন শেষে রুটটি চালু হতে যাচ্ছ, যা প্রায় ৫৫ বছর ধরে বন্ধ ছিল। পাক-ভারত যুদ্ধ শেষে ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ-ভারতের এই রেল যোগাযোগটি বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ২০১৮ সালে দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে শিলিগুড়ি থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন নির্মাণের কাজটিও শেষপর্যন্ত শুরু হয়েছে। এজন্য খুব সম্ভবত ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণও দেবে ভারত। বাংলাদেশের ৫০তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের অংশ হিসেবে নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর করলে এ ঘোষণা আসতে পারে।
এরপরও গুরুত্বের বিষয় ঢাকার মেজাজ পাল্টে যাওয়া! এটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ায় চূড়ান্ত বাস্তববাদী হিসেবে দেখিয়েছেন। চীনের সঙ্গে প্রকাশ্যে কৃত্রিম ভালোবাসা দেখাচ্ছেন। যদিও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে চীন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। এমনকি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ যখন জাতিসংঘের সদস্য পদ পেতে আবেদন করে, তখনও ভেটো দিয়েছিল চীন।
সুতরাং শেখ হাসিনা এক দিকে মোদির সঙ্গে ১৭ ডিসেম্বর ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেবেন, অন্যদিকে শি জিনপিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রস্তুত।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা দিল্লিতে একটি বার্তা পাঠাতে চান যে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশি অভিবাসীদের 'উইপোকা' উল্লেখ করে তাদের বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া উচিত বলে যে মন্তব্য করেছেন সেটি তিনি ভুলবেন না। ভুলতে পারবেনও না। এছাড়া ভারতের জাতীয় নাগরিকত্ব তালিকা (এনআরসি) এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনও (সিএএ) ঢাকার উদ্বেগের বিষয়। যদিও ভারতীয় কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, এনআরসি এবং সিএএ দুটোই তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
তবুও সবকিছু হারিয়ে যায় না! বাংলাদেশ সম্প্রতি চীনকে বলেছে, কভিড-১৯ টিকার ট্রায়াল চালাতে হলে অর্থ দিতে হবে, তা না হলে হবে না। এ কথা বাংলাদেশ তখনই বলল, যখন তিন কোটি ডোজ টিকা কেনার জন্য ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে একটি চুক্তি করছে।
শেষ কথা হলো, মোদি সরকার বিজেপির আদর্শগত এজেন্ডাকে জাতীয় প্রয়োজনীয়তার ওপর দিয়ে মোটামুটিভাবে চালানোর অনুমতি দিতে পারে না। ভারতের বৈদেশিক নীতি এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল প্রতিবেশী অঞ্চলের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ, যা দলীয় বিবেচনায় রেখে দেওয়া ঠিক হবে না। তাই নরেন্দ্র মোদিকে অবশ্যই জোর দিয়ে বলতে হবে, যে কোনো বিবেচনায় বাংলাদেশ আলাদা।
নিবন্ধটি ভারতীয় গণমাধ্যম ‘দ্য প্রিন্ট ডট ইন’-এর অনলাইন সংস্করণে ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত।
মন্তব্য করুন