- চতুরঙ্গ
- বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে আঘাত ও ধর্মান্ধতা
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে আঘাত ও ধর্মান্ধতা

৫ ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সাল। বাংলাদেশের নামকরণ দিবস। হেফাজতের ভাস্কর্যবিরোধী ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে চলমান ভুল বোঝাবুঝির মধ্যেই কুষ্টিয়ায় এই ৫ ডিসেম্বর (২০২০) রাতে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙল দুর্বৃত্তরা। পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ করা হলো কেন- স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও সেই প্রতিশোধেই যেন নামকরণকারীর স্মারক ভাস্কর্যের ওপর এ আঘাত। তার সপ্তাহখানিক আগে হেফাজতের সমাবেশ থেকে মাওলানা মামুনুল হক দোলাইরপাড়ের তীরে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করা হলে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে বলে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দেন। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের লাইভে এসে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কথা কাউকে বলেননি বলে জানানো হয়। এদিকে, ভাস্কর্যবিরোধিতার নামে বাংলাদেশের জন্মের বিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে আঘাতের ঘটনায় শুধু মুচকি হাসছে, তা নয়; তারা আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গায়ে আঘাত দিয়ে দেখল। সিসি টিভির রের্কড পাওয়া গেছে। পুলিশ তাদের চারজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। কাজেই কারা স্বাধীনতার স্থপতির স্মারক ভাস্কর্য ভেঙেছে- সে বিতর্কে এখানে আর যাচ্ছি না।
বাংলাদেশে ভাস্কর্য ইস্যু নতুন নয়। আওয়ামী লীগ সরকারে না থাকলে এই ইস্যুও শীতনিদ্রায় চলে যায়। এক নজরে যদি নিচের ৩টি ইংরেজি শব্দের অর্থ দেখি তাহলে ভাস্কর্য বিষয়ে একটি সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। ১. স্কাল্পচার-ভাস্কর্য (শৈল্পিক স্থাপত্যে প্রতিকৃতি। ২. স্ট্যাচু-মূর্তি, যা দু'প্রকার। (ক. উপাস্য ধারণা খ. রূপক প্রতিকৃতি। যেমন :দোকানের ডামি ডল/ পুতুল) ৩. আইডল-প্রতিমা (পূজনীয় ভজনীয় প্রতীক)। এক মিনিটের জন্য যদি বলি, দুটোর নাম একই। কিন্তু তার তো প্রকারভেদ আছে- সেটা অস্বীকার করে পূজার মূর্তি বলে অপবাদ দেওয়া দুরভিসন্ধিমূলক।
কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা হলো রাষ্ট্রক্ষমতায় যখন আওয়ামী লীগ বহাল তবিয়তে। আমরা দেখেছি, দেশে জঙ্গিবাদী বোমা হামলা হয়েছে মাজারে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অফিসে, উদীচীর অনুষ্ঠানে, আওয়ামী লীগ ও সিপিবির জনসভায়, বৈশাখী রমনার বটমূলে, বিচারালয়সহ সর্বশেষ শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টায় প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক নেতাকর্মী হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাযজ্ঞ। একটি অনিয়মে চলতে অভ্যস্ত জাতিকে নিয়ে শেখ হাসিনা যাত্রা করেছিলেন রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতাকে সঙ্গে করেই। এ সরকারের কোনো ভুল-ত্রুটি নেই- এমনটা বলা যাবে না। তবে আমরা সমালোচনাই বেশি করি। অহরহ যেন শুনছি- গ্লাসে পানি অর্ধেকটা নেই। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কুপ্রথা ও দৈনন্দিন উদ্ভূত সমস্যা সংস্কারে ব্যর্থতা নেই- এ কথা হলফ করে হয়তো বলা যাবে না। তবে বড় বড় সফলতা ম্লান করে দিয়েছে এসব ব্যর্থতা। অকপটে এই সফলতা স্বীকার করতেই হয়। তবে বাংলাদেশ আরও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারত যদি শেখ হাসিনার অধিকাংশ নেতা তার মতো সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারতেন। মানুষ এখন বিশ্বাস করে, আওয়ামী লীগের বিকল্প নতুন যে কোনো দলের আবির্ভাব হতেই পারে। কিন্তু শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাই।
আজ কিছু আলেম নামধারীর দেশের জন্য আলগা পিরিতি দেখলে সত্যি অবাক লাগে। তবে কি বিশ্বের ইতিহাসে স্বাধীনতাবিরোধী কর্তৃক স্বাধীনতার কৃতিত্ব ও মালিকানা ছিনতাইয়ের সবচেয়ে বড় এবং বিরল ঘটনাটি বাংলাদেশেই ঘটেছে? যে দেশে ৬৪ জেলায় একযোগে সিরিজ বোমাও ফুটেছে। লক্ষ্যবস্তু ছিল সেই প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা, নারী শিক্ষা, দেশীয় সংস্কৃৃতি, শিল্পকলা, ইতিহাস-ঐতিহ্য ইত্যাদি। যদিও তদানীন্তন কেয়ারটেকার সরকার আবদুর রহমান, বাংলা ভাই নামে পরিচিত জঘন্য ধর্মীয় উগ্রবাদীকে গ্রেপ্তার করেছিল, তবে তা দেরিতেই। তার আগে বাংলা ভাই, ইংরেজি ভাই বলে কিছু নেই বিবৃতিতে আশকারা দেওয়া হতো রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ চেয়ারে বসেই। মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিতে বেরিয়ে এসেছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করতে কীভাবে জঙ্গিবাদকে ব্যবহার করা হয়েছে এবং কীভাবে ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলা করা হয়েছে। জঙ্গিবাদের পথে এভাবে হাঁটতে হাঁটতে বাংলাদেশ একেবারে প্রায় খাদের কিনারায় চলে গিয়েছিল। এমন একটি সময়ে অবিচক্ষণ একটি জাতির অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে শেখ হাসিনা এসেছেন।
এক সময় এমন ধর্মান্ধ গোষ্ঠীই বলত, ইংরেজি ভাষা হারাম, মাইক্রোফোন হারাম, ছবি তোলা ও দেখা হারাম, শিখা চিরন্তন হারাম, নারী নেতৃত্ব হারাম ইত্যাদি। ছবিও কিন্তু মূর্তি বা ভাস্কর্যের মতো প্রতিকৃতি। ছবির থাকে টু ডাইমেনশন, আর ভাস্কর্যের থ্রি ডাইমেনশন; এই যা পার্থক্য। হজে যেতে ছবি লাগে, কায়েদে আযম কিংবা বঙ্গবন্ধুর ছবিওয়ালা টাকা পকেটে নিয়ে নামাজ পড়ে সবাই। অথচ পাঠ্যপুস্তক থেকে মুক্তিযুদ্ধের ছবিসহ সব ধরনের ছবি ফেলে দেওয়া হয়েছে কাদের পরামর্শে? এদিকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগের হেফাজত তোষণনীতিকে দুধ-কলায় সাপ পোষার পরিণতি বলছেন অনেকেই। সে জন্য ছোবলটা ঠিকই একেবারে কলিজার ভেতরে ঢুকে মারছে এখন।
বঙ্গবন্ধুকে সুযোগ পেলে প্রজন্মের মন থেকে মুছে দেওয়ার সেই আশঙ্কা থেকেও ভাস্কর্য স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা একেবারে অমূলক নয় বলে মনে করি। ইনিয়ে বিনিয়ে ভাস্কর্যের বিরোধিতা থাকবে। সবাইকে যে সমর্থন করতে হবে, বিষয়টি এমনও না। মুখে মুখে নয়, সবার ভেতর যদি বঙ্গবন্ধুর প্রতি সমান কৃতজ্ঞতাবোধ থাকত, তাহলে এদেশে ভাস্কর্য বানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নতুন করে চেনানোর দরকার হতো না। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন এই দেশটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। তার দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের ফসল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও আজকের বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু প্রশ্নে দলমত নির্বিশেষে কৃতজ্ঞচিত্তে ঐকমত্যে পেঁছাতে হবে। তার দেশপ্রেম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার আদর্শ দেশকে এগিয়ে নেওয়ার অনুপ্রেরণা। বঙ্গবন্ধুর সেই আদর্শ অকপটে সবারই ধারণ করা উচিত। দুঃখজনকভাবে খোদ আওয়ামী নামধারীদের অনেকেই আজ তার সেই আদর্শবিচ্যুত। এই মহান জাতীয়তাবাদী নেতাকে শুধু প্রতিপক্ষ আওয়ামী নেতা ভেবে বিরোধিতার খাতিরে অস্বীকার করা উচিত নয়। গায়ের জোরে কিংবা সঠিক ইতিহাস র্চচার দৈন্য নিয়ে সেটা অস্বীকার করলে সংঘাত অনিবার্য। আর সংঘাতপূর্ণ অস্থিতিশীল রাষ্ট্র কখনও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করেই দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।
মন্তব্য করুন