- চতুরঙ্গ
- শহীদের প্রতিদান
শহীদের প্রতিদান

নবগঙ্গা নদীর পাশে, ইছামতীর বিলের সঙ্গে শ্যামল সবুজে ভরা আমার গ্রাম- নহাটা। গ্রামটি তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার মহম্মদপুর থানার নহাটা ইউনিয়নের অধীনে। বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের মাগুরা জেলার একটি আদর্শ গ্রাম। বাংলাদেশের দীর্ঘ স্বাধীনতা-সংগ্রামের পটভূমিতে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নহাটাবাসীর ভূমিকা অতুলনীয়। দেশ বিভাগের পর পশ্চিমাদের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে নহাটার মানুষ সব সময় সংগ্রাম করে আসছে।
৭ মার্চ ১৯৭১, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নহাটাবাসীর পক্ষ থেকে নজরুল ইসলাম ও এয়াকব মিয়ার নেতৃত্বে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে ওঠে। এ সময় আমার চাচা নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ গঠন, পরিচালনা নীতিনির্ধারণ ও উচ্চতর পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধের শুরুতে নজরুল ইসলাম ও এয়াকব মিয়ার বাহিনী নহাটাসহ আশপাশের এলাকায় বিশেষ যুদ্ধ তৎপরতা শুরু করে।
বাঙালিরা জঙ্গলে, কচুরিপানার তলে, পাটের ক্ষেতে, ধানের ক্ষেতে, মাটির তৈরি মরিচার তলে সব জায়গায়। রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ছাড়া কোনো উপায় নেই। বাঙালির রক্তে বইছে তুফান, তারা গাইছে দেশের গান।
'আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি। তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।' সবার মুখে একই কথা, 'এ দেশ ছাড়বি কিনা বল?' যুদ্ধ চলছে। হঠাৎ অন্ধকার ঘনিয়ে এলো আমাদের পরিবারে। বিরাট কিছু পেতে, দিতে হলো এক সাগর রক্ত, দিতে হলো ভালোবাসার জলাঞ্জলি, দিতে হলো মা-বোনদের ইজ্জত, উৎসর্গ করতে হলো রাশেদ ভাইয়ের জীবন।
১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর একটি অপারেশন শেষ করে হাজীপুর বাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা। তারা মাগুরা-ঝিনাইদহের সীমান্তবর্তী শৈলকূপার কামান্না গ্রামে মাধবকুণ্ড নামের এক ব্যক্তির বাড়ির পরিত্যক্ত একটি টিনের ঘরে রাত যাপনের জন্য অবস্থান নেয়। রাজাকারদের মাধ্যমে তাদের এ অবস্থানের খবর শৈলকূপা ও মাগুরার পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে যায়। এ খবরে শৈলকূপা ও মাগুরার পাকিস্তানি সেনারা ২৬ নভেম্বর ভোররাতে ওই বাড়ি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিতে গুলিবর্ষণ করে। সে সময় ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং তাদের মধ্যে রাশেদ ভাইও ছিলেন। বাড়ির মালিক এখনও সে অবস্থায় বাড়িটি রেখে দিয়েছেন। কামান্না গ্রামের গণকবরে শুয়ে আছেন আমাদের ভাই রাশেদ।
আজ এত বছর পর জাতির কাছে আমার প্রশ্ন- ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা একরাতে একসঙ্গে শহীদ হয়েছিল এই বাংলাদেশের জন্য। কতজন তা জানে? জানা হয়নি অনেক অজানা আজও। ২৭ জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার অকালমৃত্যু বাংলার স্বাধীনতার জন্য। কেউ তো তা নিয়ে মিছিল করেনি আজও যেন কামান্না দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়!
সবার সম্মিলিত ত্যাগ ও সাহসিকতায় দেশমাতৃকার মুক্তি ত্বরান্বিত হতে পেরেছিল বলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাসে নহাটার নাম হৃদয়ে লেখা থাকবে। আনন্দের সঙ্গে বলতে হয়, যারা নহাটার হয়ে দেশ স্বাধীনে জড়িত ছিলেন, সবাই আমার অত্যন্ত আপনজন। কেউ ভাই, কেউ চাচা, কেউ মামা। অনেকে শহীদ হয়েছেন যুদ্ধে, বাকিরা সময়ের সঙ্গে মারা গেছেন। এখনও এক ভাই ও ছোট কাকা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার ১০ বছর পর দেশ ছেড়েছি বটে, তবে স্মৃতির জানালা খুলে প্রতিদিন চেয়ে দেখি দূরপরবাস থেকে, মনে হয় এই তো সেদিনের কথা।
গত এক বছর গোটা বিশ্বের মানুষ যে ভোগান্তি এবং ত্যাগ স্বীকার করছে করোনা মহামারিতে, তারাই জানে সে যন্ত্রণা এবং বেদনার দাহ্য। আপনজনকে হারানোর বেদনা সব সময় পীড়াদায়ক, যা ঘটেছিল ১৯৭১-এ। আমরা স্বাধীন হলাম ঠিকই, কিন্তু হারালাম আপনজনদের। হারালাম আমার রাশেদ ভাইকে। প্রিয় ভাই জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করলেন, অথচ উপভোগ করতে পারলেন না। আজ আমরা যারা বেঁচে আছি, 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না'- এই গানটি মনে করিয়ে দেয় তাদের কথা।
মন্তব্য করুন