বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১ বছর ও স্মার্ট বাংলাদেশ

সমাজের পিছিয়ে পড়া, সুযোগ বঞ্চিত এবং অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষাসেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ৩১ বছর আগে ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর শিক্ষাধারায় এক নতুন গন্তব্য নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের। জায়গার মানুষকে জায়গায় রেখে উন্মুক্ত ও দূর শিক্ষণের মাধ্যমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানবসম্পদের উন্নয়ন ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে ব্রতী হয়ে বাউবি প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত নিজস্ব শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। দীর্ঘ একত্রিশ বছরের পথচলায় জায়গার মানুষকে জায়গায় রেখে শিক্ষা সেবা পৌঁছে দেয়ার স্বপ্ন পূরণ করেছে বাউবি। বাউবির মাধ্যমে বিপুল জনগোষ্ঠী জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখছে।

ঘরে বসে শিক্ষার সুযোগ পেয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী, পিছিয়েপড়া নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ সব বয়সের, সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ মানুষ সবাই একই ছায়াতলে যুক্ত হয়ে এগিয়ে এসেছে  বাউবির শিক্ষার আলোক ধারায়। 

ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে বাউবির প্রযুক্তিবান্ধব শিক্ষার মাধ্যমে চালু হয়েছে বহিঃ বাংলাদেশ শিক্ষা কার্যক্রম। প্রবাসে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠী ও রেমিটেন্স যোদ্ধারা সেখানে বসেই লেখাপড়া ও পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে পারছে। বর্তমানে বাউবির বহিঃ বাংলাদেশ শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদিআরব, কাতার, কুয়েত ও ইতালিতে এসএসসি, এইচএসসি ও বিএ/বিএসএস শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। প্রবাসী  রেমিটেন্স যোদ্ধারা বাউবির বহিঃ বাংলাদেশ শিক্ষা প্রোগ্রামের মাধ্যমে শিক্ষিত ও দক্ষ হয়ে আত্মমর্যাদা নিয়ে টিকে থাকতে পারছে। বৈশ্বিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে রেমিটেন্স যোদ্ধারা দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। 

বাউবির প্রযুক্তিবান্ধব শিক্ষাসেবায় যুক্ত রয়েছে ই-বুক, বাউবি ওপেন টিভি, ওয়েব টিভি, ওয়েব রেডিও, বাউবি টিউব, বাউবি অ্যাপস, মোবাইলআ্যাপস, টুইটার, ফেসবুক, ইমেইল, ই-লার্নিং, এলএমএস এবং অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম। বাউবিতে প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাকার্যক্রম চালু হওয়ায় শিক্ষাব্যবস্থাপনায় এসেছে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছে বাউবির প্রযুক্তিবান্ধব শিক্ষাধারা। আজ আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির প্রায় সব কিছুই বাউবির শিক্ষা কার্যক্রমে প্রয়োগ হচ্ছে। 

অনলাইন ও ই-প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে ভর্তি, রেজিস্ট্র্রেশন, ক্লাস, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, ফল প্রকাশ ও শিক্ষকদের সঙ্গে মুক্ত আলোচনা সবই জায়গায় বসে সম্ভব হচ্ছে। অনলাইনে বাউবির বিভিন্ন প্রোগ্রামের লেকচার আপলোড থাকায় শিক্ষার্থী এবং আগ্রহী যেকেউ ওয়েব সাইট থেকে বিনামূল্যে সেসব ই-বুক ও লেকচার ডাউনলোড করতে পারছে। নিজের সুবিধামতো সময়ে, কাজের ফাঁকে, কাজের শেষে, রাতে-দিনে যেকোনো সময়ে ঘরে অথবা নিজ কর্মস্থলে বসে শিক্ষা লাভের সুযোগ তৈরি করেছে বাউবি। শিক্ষার্থী ছাড়াও যে কেউ নিজের প্রয়োজনীয় ও পছন্দের বিষয় বাউবির ওয়েব সাইট থেকে নিয়ে নিজ জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে পারছে। বাউবির শিক্ষার্থী ও স্টেকহোল্ডারদের জন্য নিয়মিতভাবে বাউবির নানা তথ্য ওয়েবসাইটে আপডেট করা হয়। মোবাইল ম্যাসেজের মাধ্যমে ভর্তি, রেজিস্ট্রেশনসহ একাডেমিক তথ্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

বাউবির শিক্ষা ব্লেনডেড মোডে পরিচালিত। শিক্ষার্থীরা যেমন ভার্চুয়াল শিক্ষাব্যবস্থায় ঘরে বসে লেখাপড়া করতে পারছে, অপরদিকে তাদের জন্য রয়েছে টিউটোরিয়াল ক্লাসের ব্যবস্থা। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে স্টাডি সেন্টারে গিয়ে তারা টিউটোরিয়াল ক্লাসে মিলিত হয়। শিক্ষার্থীর কাছে পাঠ্যবইয়ের কোনো অনুশীলনী কঠিন মনে হলে টিউটোরিয়াল ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ে পাঠ আলোচনায় অংশ নিয়ে সমস্যাগুলো সমাধান করে নেয়।

মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও সময়-সুযোগের অভাবে যারা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে লেখাপড়া করতে পারছেন না বাউবি তাদের উপযোগী করে শিক্ষা কাঠামো তৈরি করেছে। বাউবি সকল শিক্ষার্থীকে বই/পাঠ সামগ্রী সরবরাহ করে থাকে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পরীক্ষার্থী একবার যে বিষয়ে পাস করে তাকে আর দ্বিতীয়বার সে বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয় না। এটি একটি যুগান্তকারী ব্যবস্থা, যা এদেশের অন্য কোনো শিক্ষাবোর্ডে  নেই। শিক্ষা প্রোগ্রামের কোয়ালিটি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বাউবির রয়েছে কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল। 

বাউবির রয়েছে একটি অত্যাধুনিক মিডিয়া সেন্টার। এই মিডিয়া সেন্টারের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী দ্বারা শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচি ও মডিউল অনুযায়ী অডিও-ভিডিও ক্লাস লেকচার নির্মাণ করে ইন্টারনেটভিত্তিক ওয়েব  রেডিও এবং ওয়েব টিভির মাধ্যমে প্রচার করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভির মাধ্যমেও পাঠ প্রচার করা হয়ে থাকে। 

ঘরের কাছ থেকে মানুষ যাতে বাউবির সেবা পেতে পারে সেজন্য সারা দেশজুড়ে রয়েছে বাউবির আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্র। প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শিক্ষাসেবা সম্প্রসারণ ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের দূর শিক্ষণের মাধ্যমে আলোকিত করে যাচ্ছে। বর্তমানে বাউবিতে এসএসসি থেকে শুরু করে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাকার্যক্রম চালু রয়েছে। সময়ের চাহিদার সাথে মিল রেখে বাউবি নীডবেইজ প্রোগ্রাম ও কোর্স চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সকল পেশাজীবীদের হাতের নাগালে শিক্ষাসেবা পৌঁছে দেয়া এবং কর্মমুখী জনগোষ্ঠী তৈরি করতে চালু করেছে নানা ধরনের প্রফেশনাল প্রোগ্রাম ও জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে রেসিডেন্সিয়াল রিসার্চ ক্যাম্পিংয়ের জন্য বাউবির গাজীপুরস্থ মূল ক্যাম্পাসের গেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

বাউবি তৈরি করেছে একটি সময়োপযোগী একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান ও অর্গনোগ্রাম। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার প্রতিভা বিকাশে রয়েছে নানা উদ্যোগ। পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর লেখাপড়ার সুযোগ দানের জন্য রয়েছে ইনক্লুসিভ এডুকেশন ফর ওপেন স্কুলিং। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে শিক্ষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত বিষয়ে সমঝোতা স্মারক চুক্তির মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম। সরকারের বার্ষিক কর্মসম্পাদান চুক্তি বাস্তবায়ন, অগ্রগতি ও পরিকল্পনায় বাউবি এগিয়ে রয়েছে।

একজন গার্মেন্টসকর্মী বা শিল্প কারখানার শ্রমিক বা রিকশাওয়ালা যেমন বাউবির শিক্ষার্থী, অপরদিকে সরকারি-বেসরকারি ও ডিফেন্সের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, গবেষক, শিক্ষক, নার্স, রাজনীতিবিদ, ক্রীড়াবিদ, শিল্পী, কবি সাহিত্যিক, গণমাধ্যমকর্মী সবাই বাউবির শিক্ষার্থী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার একজন ফটোগ্রাফার বাউবির শিক্ষার্থী ছিলেন।

বিভিন্ন বিষয়ে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে বাউবির রয়েছে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম। যা দেশের প্রয়োজন ও উন্নয়ন কর্মধারার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। গ্রামগঞ্জসহ বিভিন্ন পরিবেশে অবস্থানরত বেকার যুবক-যুবতীদের বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে।

 নারী শিক্ষায় এক অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দিয়েছে বাউবির দূরশিখন পদ্ধতি। বাউবির মোট শিক্ষার্থীর ৬১.০৭ শতাংশ পুরুষ এবং প্রায় ৩৯ শতাংশ নারী। বাউবির  মাধ্যমে শিক্ষা ও জ্ঞান লাভ করে চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়ে নারীসহ কর্মক্ষেত্রে আজ অনেকেই স্বাবলম্বী, যা বাউবির ঐকান্তিক প্রচেষ্টার সফল রূপায়ন।

আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমকে কাজে লাগিয়ে দক্ষ জনশক্তি সৃজন, মানবসম্পদ তৈরি, পরিবেশের উন্নয়ন, নারীশিক্ষার প্রসার ও পেশাগত শিক্ষার প্রয়োজনে বাউবি নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এটি একটি মেগা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। ইতোমধ্যে বাউবি বাংলাদেশের জেলা-উপজেলা, গ্রামগঞ্জ, দূর্গম পার্বত্য অঞ্চলের নৃ-গোষ্ঠী, সুবিধাবঞ্চিত, দরিদ্র ও সুযোগবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের  দূর শিক্ষণের মাধ্যমে আলোকিত করতে পেরেছে।  

দেশে-বিদেশে শিক্ষা বিস্তারে বাউবি সবসময় সবার জন্য উন্মুক্ত। নানা উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া, মিডিয়া এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ইতোমধ্যে বাউবি জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। দেশমাতৃকার উন্নয়নে শিক্ষায় উন্নত বাংলাদেশ সৃজন, দেশে উৎকর্ষ শিক্ষাসেবা ও সরকারের রূপকল্প বাস্তবায়ন, ডিজিটাল শিক্ষা বিস্তরণ, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও ডেল্টাপ্ল্যান বাস্তবায়ন এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী শিক্ষার মান উন্নয়নে বাউবি অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

ড. মেজবাহ উদ্দিন তুহিন: গবেষক ও লেখক, পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), তথ্য ও গণসংযোগ বিভাগ, বাউবি।