অবশেষে ১৮ মার্চ থেকে সরাসরিই বইমেলা হচ্ছে। আমরা জানি, প্রতি বছর পহেলা ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে এই বইমেলার উদ্বোধন করা হয়। মহামারি করোনার কারণে এ বছর বাঙালির প্রাণের এই বইমেলা কীভাবে হবে- সরাসরি নাকি অনলাইনে অর্থাৎ একচুয়াল নাকি ভার্চুয়াল- এ নিয়ে চলছিল আলোচনা-সমালোচনা। একচুয়াল ও ভার্চুয়াল দুটি শব্দই অনেক পুরোনো। তবে ভার্চুয়াল শব্দটি বেশি পরিচিতি লাভ করেছে মহামারি করোনার কারণে।

কভিড-১৯ লকডাউনের কারণে চীনসহ বিশ্বের সব দেশেরই অর্থনীতি ও মানুষের স্বাভাবিক জীবন স্থবির হয়ে পড়ে এবং বন্ধ হয়ে যায় সব ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও উৎপাদন। চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে যান বিশ্বের লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষ, দেখা দেয় খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রীর সংকট; কিন্তু মানুষের জীবনযাপন, কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বোপরি অর্থনীতির চাকা সচল রাখতেই হবে। তাই লকডাউনে যখন গোটা বিশ্ব বেসামাল তখন ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে হোম ডেলিভারির মাধ্যমে মানুষের দোরগোড়ায় এসে সেবাদান শুরু করে বিভিন্ন অনলাইন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে বর্তমানে ই-কমার্স, ই-বিজনেস, টেলিমেডিসিন ইত্যাদি অসংখ্য প্ল্যাটফর্ম অনলাইনে নানা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ভার্চুয়াল মিটিং বা ই-কনফারেন্স, অনলাইন (ই-লার্নিং) ক্লাস, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া ইত্যাদি উন্নত বিশ্বে অনেক আগে থেকেই ছিল কিন্তু এই করোনার কারণেই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অনেক দেশেই এখন ভার্চুয়ালি বা অনলাইনে লেখাপড়া, ব্যবসা-বাণিজ্য, ই-নথি পরিচালনাসহ অনেক অসম্ভব কাজ সম্ভব হচ্ছে। বলা যেতে পারে অনেক ক্ষেত্রেই করোনা যদিও একটি সংকট, এখন তা সম্ভাবনায় পরিণত হয়েছে, দুর্যোগ হলেও এটি একটি সুযোগে রূপান্তরিত হয়েছে।

কিন্তু বইমেলা বলে কথা। এর সঙ্গে বাঙালি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সর্বোপরি ভাষা আন্দোলনের আবেগ, সংগ্রাম এবং ভাষাসৈনিকদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বইমেলায় মানুষ শুধু বই কিনতে আসে না কিংবা গ্রন্থমেলা শুধুই বই বেচাকেনার জন্য নয়। বইমেলা লেখক-পাঠক-প্রকাশকসহ হাজার মানুষের মিলনমেলা। মেলা চলাকালে প্রতিদিনই মেলাতে বিভিন্ন আলোচনা সভা, কবিতা পাঠের আসর, সন্ধ্যায় থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মেলাতে রয়েছে লেখককুঞ্জ, যেখানে লেখকরা উপস্থিত থাকেন এবং তাদের বইয়ের ব্যাপারে পাঠক ও দর্শকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। আছে শিশু কর্নার, লিটল ম্যাগাজিন এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিভাজন ইত্যাদি।

মেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত নতুন মোড়ক উন্মোচিত বইগুলোর নাম, তদীয় লেখক ও প্রকাশকের নাম ঘোষণা করা হয় ও দৈনিক প্রকাশিত বইয়ের সামগ্রিক তালিকা লিপিবদ্ধ করা হয়। বিভিন্ন রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেল মেলার মিডিয়া স্পন্সর হয়ে মেলার তাৎক্ষণিক খবরাখবর দর্শক-শ্রোতাদের অবহিত করে। অনেক মা-বাবা ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান খুদে শিক্ষার্থীদের নিয়ে মেলায় ঘুরতে আসেন বাংলা ভাষার ইতিহাস জানতে এবং জানাতে। এ ছাড়া মেলায় আছে আরও নানা রকম ভিন্নতা। প্রকাশনীগুলোর স্টলগুলো প্রকাশক এলাকা, প্রকাশক-বিক্রেতা এলাকা, শিশু কর্নার, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং লিটল ম্যাগাজিন ইত্যাদি এলাকায় বিভাজন করা থাকে।

মেলা চত্বরকে ভাষা শহীদ সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউর এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের নামে ভাগ করা আছে। এই মেলায় দেশের খ্যাতনামা সব প্রকাশনী, বই বিক্রেতা ছাড়াও দেশের বাইরে- যেমন ভারত, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশ থেকেও নানা প্রকাশনা সংস্থা তাদের বই ও প্রকাশনা নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। অর্থাৎ বইমেলায় মানুষ শুধু বই কিনতেই আসে না, এটি লেখক, পাঠক, প্রকাশকসহ অসংখ্য মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। বই ছাপানো, বাঁধানো, স্টলে পাঠানো এবং পাঠকের হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত জড়িত আছে প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পের হাজার হাজার কর্মী এবং অগণিত পাঠক। তাই অনেকেই মনে করেন ভার্চুয়াল নয়, একচুয়াল বইমেলা হওয়া উচিত। প্রয়োজনে তারিখ পিছিয়ে দিয়ে হলেও যেন স্টল বসিয়ে বইমেলার আয়োজন করা হয়।

বইমেলা স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর অন্যতম। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গের যে বীরত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, সেই স্মৃতিকে অম্লান রাখতেই এই বইমেলার নামকরণ করা হয় 'অমর একুশে গ্রস্থমেলা'। যতদূর জানা যায়, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এই ৩২টি বই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। এ সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ২০১০ সাল থেকে এই মেলার প্রবর্তক চিত্তরঞ্জন সাহার নামে একটি পদক প্রবর্তন করা হয়। ১৯৮৩ সালে একাডেমির মহাপরিচালক কাজী মনজুরে মওলা প্রথম 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'র আয়োজন করেন।

কিন্তু যেই মেলার এত ইতিহাস, ঐতিহ্য, আবেগ এবং আয়োজন- সেটা সরাসরি না করে ভার্চুয়ালি করলে 'দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর' মতোই হবে; কিন্তু কী করা? ওই যে মহামারি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে বিশ্বব্যাপী, যা প্রথমটি থেকেও মারাত্মক। আমরাও মানছি না স্বাস্থ্যবিধির কোনো নিয়মকানুন। তাই একচুয়াল নয়, ভার্চুয়াল মেলাই হওয়ার সম্ভাবনা। উল্লেখ্য, নিউইয়র্কে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ২০২০ সালের ১৮ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর ১০ দিনব্যাপী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ভার্চুয়াল বাংলা বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে তথ্যপ্রযুক্তির যে অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে ভার্চুয়ালি বইমেলা করতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়- প্রশ্ন হচ্ছে এই কর্মযজ্ঞের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের রুটি-রোজগারের ব্যবস্থাটা আরও কঠিন হয়ে যাবে। এমনিতেই গত ১০ মাস ধরে এই শিল্প কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। করোনাকালে সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে প্রণোদনা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে যারা সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন, তাদের এবার প্রণোদনার আওতায় আনা উচিত।