- চতুরঙ্গ
- লাখাইর কালভৈরব মন্দিরে একদিন
লাখাইর কালভৈরব মন্দিরে একদিন

হবিগঞ্জের লাখাইর কালভৈরব মন্দিরের সামনে লেখক
গত ১৬ জানুয়ারি ২০২১ শনিবার হবিগঞ্জ জেলা তথা সিলেট বিভাগের শেষ প্রান্ত লাখাইর শ্রশ্রী কালভৈরবের মূর্তি ও মন্দির দেখে আসি। ভাটি বাংলার গুরুত্বপূর্ণ জনপদ হচ্ছে লাখাই। দুই জেলা তথা হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের মিলনকেন্দ্রও বলা যায়। এক সময়কার উপজেলা সদরের প্রধান বাজার এটি।
বাজারটিতে হবিগঞ্জের লাখাই থেকে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের লোকজনের সমাগম বেশি। প্রতিদিন ভোর থেকে রাত অবধি ক্রেতা-বিক্রেতা ও দর্শনার্থী সম্মিলনে ব্যস্ত থাকে বাজারটি। আর বাজারের মূল সড়কের মাঝ বরাবর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালভৈরবের মূর্তি ও মন্দির। তবে মন্দিরটি রাস্তার মাঝ বরাবর বলা ঠিক হবে না; বরং ভাটি এলাকায় স্থলভাগে মন্দিরটি রাস্তার পূর্বেই নির্মিত হয়। পরে মন্দিরটিকে রক্ষা করে দুই পাশে রাস্তা সম্প্রসারিত করা হয় এবং সেখানে বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ থেকে ১০২ বছর আগে জনৈক নন্দলাল বৈদ্য সাহা এ মূর্তিটি নির্মাণ করেছিলেন। দূর-দূরান্ত থেকে সনাতম ধর্মের লোকজন আসেন ভক্তি দিতে, সম্মান জানাতে। চারদিকে একটি আধ্যাত্মিক পরিবেশ। সনাতন ধর্মের অনুসারী ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার লোকজন আসেন কালভৈরবের মূর্তি ও মন্দির দেখতে। হবিগঞ্জ জেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার পশ্চিমে এর অবস্থান।
সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীদের মতে, কালভৈরব হচ্ছেন সনাতন ধর্মালম্বীদের দেবতাবিশেষ। সংস্কৃত শব্দ 'ভৈরব'-এর অর্থ ভয়ংকর বা ভয়াবহ। যা শিবের একটি হিংস্র প্রকাশ। এর সঙ্গে মৃত্যু ও বিনাশ সম্পর্কিত। তাই কালভৈরবকে মনে করা হয় মহাদেব শিবের রুদ্ররূপ। দুষ্ট শক্তির বিনাশ করতে মহাদেব এই রুদ্ররূপ ধারণ করেন। হিন্দু পুরাণ, বজ্রযানী বৌদ্ধ শাস্ত্র এবং জৈন ধর্মগ্রন্থগুলোর বক্তব্য অনুযায়ী, 'মহাজগতের বিশেষ স্থানগুলি ভৈরব রক্ষা করেন। ভৈরবের মোট সংখ্য ৬৪। তাদের আটটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। প্রতিটি শ্রেণির আবার একজন করে প্রধান ভৈরব রয়েছেন। প্রধান আট ভৈরবকে 'অষ্টাঙ্গ ভৈরব' বলা হয়। এই আটজন মহাবিশ্বের আটটি দিকের অধিপতি। এই আটজন আবার নিয়ন্ত্রিত হন মহাস্বর্ণ কালভৈরবের দ্বারা। তিনি সাধারণভাবে কালভৈরব নামেই পরিচিত। ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে উঁচু মূর্তি হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের অদূরে মেড্ডায় অবস্থিত কালভৈরবের মূর্তিটিকে বিবেচনা করা হয়। মূল কালভৈরব মূর্তিটি তিনশ বছর আগের বলে ধারণা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ডিনামাইট চার্জ করে শিব ও পার্বতী মূতিৃর অনেকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত করে। স্বাধীনতার পর তা সংস্কার করা হয়। সরাইলের বিখ্যাত জমিদার নূর মোহাম্মদ কালভৈরব মন্দিরের বর্তমান জায়গাটি দান করেছিলেন। রাজস্থান, তামিলনাড়ূ এবং নেপালের সনাতন ধর্মালম্বীদের কাছেও কালভৈরব গুরুত্বপূর্ণ দেবতা।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, মহাদেব তার নিজের শরীরের অংশ থেকে কালভৈরবের সৃষ্টি করেন। আর সেই কালভৈরবকেই কাশীধামকে রক্ষার দায়িত্ব দেন। আর বলেন : 'বৎস! যে দুস্কৃতকারী এ স্থানে সমাগত হবে তুমি তার সমুচিত দণ্ড বিধান করবে।' কাশী হলো ভারতের উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে অবস্থিত সনাতন ধর্মালম্বীদের তীর্থ স্থান। গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে বরুণা ও অসি নদীর সঙ্গমস্থলে সনাতন ধর্মালম্বীদের পবিত্র তীর্থস্থান হলো কাশী। যার মূল আকর্ষণ হলো বিশ্বনাথের মন্দির। মন্দিরের ১৫.৫ মিটার উঁচু চূড়াটি সোনায় মোড়া। কাশী বিশ্বনাথের মন্দিরের জন্য বারাণসীর অপর নাম কাশী। সনাতন ধর্মালম্বীদের বিশ্বাস, নদীর সঙ্গমস্থলে একটি ডুব দিয়ে কাশী বিশ্বনাথের মন্দির দর্শন করলে মোক্ষ লাভ করা সম্ভব। যাই হোক, কালভৈরবকে মহাদেব কাশী রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে বলেন, পূর্বে ব্রহ্মার পাঁচটি মাথা ছিল। সনাতন ধর্মমতে, ব্রহ্মা হলো সৃষ্টির দেবতা। এক সময় তিনি কন্যাভিগমনের মতো পাপে লিপ্ত হয়ে শিব তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য কাশীতে এলে মহাদেবের নির্দেশে কালভৈরব তার বাম হাতের নখ দিয়ে ব্রহ্মার এক মাথা কেটে ফেলেন। সে সময় থেকেই ব্রহ্মা চতুর্মুখ। আর যেখানে ব্রহ্মার কাটা মাথাটি পড়েছিল, তা আজ অবধি কপালমোচনতীর্থ নামে পরিচিত। অন্যদিকে ব্রহ্মার মাথা কর্তনের পাপ থেকে মুক্তির জন্য কালভৈরবকে ঘুরে ঘুরে ক্ষমা চাইতে হয়। এক সময় তিনি পাপ থেকে মুক্তিও পান। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বী তথা হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, কালভৈরবকে ভক্তি করলে পাপ ও অশুভ শক্তি থেকে মুক্তিলাভ করে জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি আসে।
অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ব্রহ্মা ও শিব উভয়েরই পাঁচ মুখ ছিল। এক সময় ব্রহ্মা শিবের থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ দাবি করে অহঙ্কার প্রকাশ করতে থাকেন। ফলে ক্ষুব্ধ শিব ব্রহ্মার একটি মাথা কেটে ফেলেন। আর এ থেকেই শিবের ওপর আসে ব্রহ্মা হত্যার পাপ। আর সেই পাপ মোচনের জন্য দীর্ঘসময় ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় থাকতে হয়। আর শিবের ভ্রাম্যমাণ রূপই হলো কালভৈরব। আবার অনেক জায়গায় কালভৈরবকে কালের শাসক বা সময়ের শাসক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
হবিগঞ্জের লাখাই বাজারে অবস্থিত কালভৈরবের মূর্তির দুই পাশের দোকানগুলোতে ব্যবসা করছেন মুসলমান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পারস্পরিক সম্প্রীতির সঙ্গে সৌহার্দ্যের সঙ্গে। দুই পাশ দিয়ে প্রতিদিন হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের হাজার হাজার পথচারী পার হচ্ছেন। দূর-দূরান্ত থেকে আসছেন অনেক সনাতন ধর্মের অনুসারী। তারা ভক্তি করছেন, শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। অনেকেই প্রসাদ দিচ্ছেন, অর্থ দান করছেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত বাজার হওয়া সত্ত্বেও কালভৈরবের মন্দিরের আশপাশে কেমন যেন একটা নিস্তব্ধতা, একটা আধ্যাত্মিক পরিবেশ। মুসলমানরাও চলার পথে কালভৈরব মন্দিরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ান কিছু সময়ের জন্য। এতদঞ্চলের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সকল ধর্মের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
মন্তব্য করুন