- চতুরঙ্গ
- শিশুদের স্কুলে ফেরানো জরুরি
শিশুদের স্কুলে ফেরানো জরুরি

ফাইল ছবি
শিশুদের ঘরে বন্দি করে রাখা, বন্ধুদের সঙ্গে দলবদ্ধভাবে বেড়ে হেসেখেলে ওঠার সুযোগ থেকে বেশি দিন বঞ্চিত রাখা সঠিক নয়। এমনকি আমাদের শিশুরাও আর ঘরের চার দেয়ালে বন্দি থাকতে চায় না, এটা গবেষণা জরিপে প্রাপ্ত তথ্য।
ওরা বিদ্যালয়ে বা শিশু বিকাশ কেন্দ্রে বন্ধুদের সঙ্গে একত্রিত হতে চায়, প্রিয় শিক্ষক বা যত্নকারীদের সঙ্গে সময় কাটাতে চায়। ওরা ছড়া-গানে-গল্পে-খেলায় মেতে উঠতে চায় আবার।
শিশুদের বিকাশে কাজ করি, তাই শিশুদের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত কথা হয়। তাদের মা-বাবার সঙ্গে আমাদের সংলাপ চলে নিয়মিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিশুরা ও তাদের মা-বাবা সবাই চায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে ঘরের বাইরে আসতে, শিশুদের বিদ্যালয়ে ফেরাতে, বন্ধুদের সঙ্গে মেশাতে। অনেক দেশেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে কিংবা বিশেষ ব্যবস্থায় শিশুদের বিদ্যালয়ে বা শিশু বিকাশ কেন্দ্রে আসা ও বিকাশ-শিখন কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে কিংবা পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কারণ বড়দের ঘরে আটকে থাকা আর শিশুদের ঘরে আটকে রাখা বা থাকা এক নয়। সমাজবিচ্ছিন্ন ও বিকাশবঞ্চিত থাকা দুটিই শিশুর জীবনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, যা বড়দের ক্ষেত্রে এতটা ঘটে না। বড়রা নানাভাবে পুষিয়ে নিতে পারলেও শিশুদের বিকাশবঞ্চনা পুষিয়ে দেওয়া যায় না। দুঃখের বিষয় আমরা সব কাজের মতো তাতেও শিশুদের নয়, বড়দের বিষয়টাই প্রাধান্য দিচ্ছি। অথচ শিশুদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা আমরা দিইনি।
আমি ২-৫ বছরের অনেক শিশুর সঙ্গে ফোনে আলাপ করেছি, ওরা বলে স্কুলে যেতে চাই। কেউ বলে খেলতে চাই, কেউ বলে গান গাইতে চাই। শিশুরা আর ঘরে থাকতে চায় না। এরা সবাই গ্রামের শিশু। অনেকে বলে, গ্রামের শিশুরা আছে ভালো, শহরের শিশুরা বাসায় বন্দি, খাঁচায় আটকে আছে ১০ মাস ধরে। আসলে সব শিশুই বন্ধুদের সঙ্গ চায়। বিদ্যালয় বা শিশুবিকাশ কেন্দ্রে এলে তা সঠিকভাবে সম্ভব, বাসাবাড়ি তা গ্রাম কিংবা শহরে কম-বেশি কোথাও সম্ভব নয়।
ফোনালাপ কিংবা অনলাইনে ছড়া-গান-গল্প আর বিদ্যালয়/কেন্দ্রের কার্যক্রম দুটি মাধ্যম যে আলাদা তা শিশুদের কথাতেই ফুেিট ওঠে। ফোনালাপে ছড়া-গান-গল্প দিয়ে ওদের মন ভরে না। ওরা বলে আপামণি, স্কুল/কেন্দ্রে আসব। শিশু বিকাশ কেন্দ্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে প্রিস্কুলের বিকল্প কোনো কিছুই হতে পারে না, না দূরালাপনী, না অনলাইন মাধ্যম।
বাংলাদেশের একটি অনলাইন কারিকুলাম কনটেন্ট স্ট্ক্রিপ্ট ও রুটিনের সঙ্গে কেন্দ্রভিত্তিক স্বাভাবিক কারিকুলাম কনটেন্ট ও রুটিনের তুলনামূলক বিশ্নেষণ করে যা পেয়েছি তা এতই দূরবর্তী তুলনা যা বলতেও সংকোচ হচ্ছে। কেন্দ্রভিত্তিক স্বাভাবিক কারিকুলাম কনটেন্ট ও রুটিনের শতকরা ৫-১০ ভাগও পূরণ হয় না। দুর্যোগে ৫-১০ ভাগ হলেও মেনে নিতে হয়। কিন্তু শিশুদের যে জাতি অগ্রাধিকার দেয় তারা দুর্যোগেও শিশুদের বিকাশ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে না, সব ধরনের প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করে সমান সুযোগ, প্রয়োজনে বিকল্প উপায়ে অব্যাহত রাখে। আমরা উন্নয়নের নানান সূচকে দেশকে নানান রেটিংয়ে উন্নীত হয়েছে দাবি করে গর্ববোধ করি; কিন্তু কাঙ্ক্ষিত আয়ের দেশের সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত মানের ও স্তরের সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে থাকি পিছিয়ে, নীরব ও নিষ্ফ্ক্রিয়, যা স্পষ্ট স্ববিরোধিতা। উন্নয়ন ও সেবার স্ববিরোধিতা। সংখ্যাগত উন্নতি ও মানের স্ববিরোধিতা। এসবই শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
শিশুদের, বিশেষ করে শিশুদের বন্ধুদের সঙ্গে দলবদ্ধ খেলা, ছড়া-গান-গল্প ইত্যাদি ফোনে যা করা হয়, তাতে দুধের স্বাদ ঘোলের মতোও মেটে না। বিশেষজ্ঞদের মতে এটা অসম্ভব। শিশুদের বন্ধুদের সঙ্গে দলবদ্ধ খেলা, ছড়া-গান-গল্প ইত্যাদির চাহিদা মুখোমুখি কেন্দ্রেই দিতে হবে, এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে হলেও দিতে হবে। প্রকারান্তরে আমরা শিশুদের বঞ্চনার প্রভাব যে কী হতে পারে তাও বুঝি না, পরিমাপ করতে পারি না।
শিশুদের জীবনে ১০টি মাস মানে প্রায় একটি বছর করোনার কারণে বা অন্য কোনো কারণে যে কোনো সময় হারিয়ে গেলে কী ক্ষতি হয় তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? শিশুর মস্তিস্কের সবচেয়ে বেশি বিকাশ হয় যে সময়ে, তখন যদি দশটি মাস, প্রায় একটি বছর বঞ্চনার শিকার হয়, তা তার মস্তিস্কের বিকাশে প্রভাব ফেলে- এটা কি বোঝা রকেট সায়েন্সের মতো কোনো কঠিন কিছু। এ সময় শিশুদের সামাগ্রিক বিকাশের প্রতিটি ক্ষেত্রে যত্ন ও পরিচর্যা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তা থেকে বঞ্চিত হলে যে তাদের সামগ্রিক বিকাশ সময়মতো হবে না এবং এর প্রভাব যে কতটা ক্ষতিকর ও পুষিয়ে নেওয়া কঠিন, তা শিশু বিকাশ বিষয়ে পড়ালেখা জানা ব্যক্তিরা জানেন, অন্যদেরও অনুভূতি দিয়ে বুঝে নেওয়া কঠিন নয়। তবুও দিনের দিন, মাসের পর মাস শিশুরা বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। এছাড়া সহযোগী সংস্থার গবেষণায় আরও নানা ধরনের ক্ষতিকর দিক উঠে এসেছে শিশুদের জীবনে, যা দেশের নীতিনির্ধারকদের ভাবা জরুরি।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়গুলো যা সংবাদমাধ্যমে এসেছিল, তাতে আশাবাদী হয়েছিলেন শিশুর অভিভাবক ও শিশু বিকাশ ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। আমরা আশাবাদী, শিগগিরই এই সিদ্ধান্ত শিশুদের স্বার্থের অনুকূল হবে। নতুন বছর আশাবাদ দিয়ে শুরু হয়েছে। আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধে শিশুদের স্বার্থ সর্বাধিকার দেওয়া হবে, তাদের বিকাশের ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় আনা হবে, যা একটি উন্নয়নের রোলমডেলের দাবিদার জাতির কাছে কাম্য।
বিষয় : শিশুদের স্কুল
মন্তব্য করুন