কবি, লেখক ও সাংবাদিক মুস্তাফিজ শফি দৈনিক সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবং সম্পাদক পরিষদের কোষাধ্যক্ষ। বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নানা দিক নিয়ে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগ তার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে শুক্রবার। হারুণ উর রশীদ স্বপনের নেওয়া এই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা জরুরি। এটা ব্যাহত করার চেষ্টা করা মানে বুঝে হোক না বুঝে হোক গণতন্ত্রেরই ক্ষতি করা। সাক্ষাৎকারে তিনি স্বৈরাচারী শাসনামল থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক শাসনামল পর্যন্ত সংবাদমাধমের প্রতি সরকারের মনোভাব তুলে ধরেন। সমকালের পাঠকের জন্য সাক্ষাৎকারটি অনলাইনে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে কি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন যথেষ্ট হচ্ছে? আপনি নিজেও তো একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলবেন?

মুস্তাফিজ শফি: বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সিরিজ প্রতিবেদনের প্রথম উদাহরণ দৈনিক ইত্তেফাকে আবেদ খানের ‘ওপেন সিক্রেট’। ওপেন সিক্রেট ছিল মূলত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর সরেজমিন প্রতিবেদন। সেটাকে যদি আমাদের প্রথম ভিত্তি ধরি, তাহলে আমি বলব যে, আমাদের দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অনেক এগিয়েছে।

আপনি আমার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কথা বলেছেন। আমাদের শুরুর সময়টায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সুযোগটা বেশি ছিল না। আমাদের প্রথমত, সে রকম প্রশিক্ষক ছিল না। লেখাপড়া করার খুব বেশি সুযোগ ছিল না। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ নামে একটি বিভাগ ছিল। বেসরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আমি নিজে সাংবাদিকতায় পড়িনি, বাংলায় পড়েছি। আমি কাজ করতে করতে একেবারে মফস্বল থেকে শুরু করে, সাংবাদিকতার প্রতিটি স্তর পেরিয়ে এখন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি।

আগে যে সুযোগের অভাব ছিল, এখন কিন্তু সে রকম না। এখন সবাই জেনে-বুঝে সাংবাদিকতায় আসছেন। তারা জানেন, অনুসন্ধান কীভাবে করতে হয়। সমস্যা অন্য জায়গায়। শুধু সাংবাদিকতায় নয়, সব ক্ষেত্রেই শর্টকাট করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এই শর্টকাটে জনপ্রিয়তা অর্জন, অতিক্রম করার প্রবণতা, সেই প্রবণতা কিন্তু সাংবাদিকতাকেও পেয়ে বসেছে।

ডয়চে ভেলে: বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কতটা এগিয়েছে?

মুস্তাফিজ শফি: শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিকভাবেও এই শর্টকাট প্রবণতা আছে। আমরা যদি পুলিৎজার পুরস্কারগুলো পর্যালোচনা করি, সেখানেও যে পুরস্কারগুলো পাচ্ছে, সেই বিবেচনা করলে বাংলাদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা একেবারে পিছিয়ে আছে তা বলা যাবে না। এখানকারও অনেক প্রতিবেদন বৈশ্বিক যে বিভিন্ন সংস্থা আছে, সেখানে বিবেচনার মধ্যে গিয়েছে। সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন, যেটা রোজিনা ইসলাম করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের যে পদক দেওয়া হয়েছে, সেখানে জালিয়াতি হয়েছে- এই রিপোর্টটিকে কিন্তু আমি একেবারে বিশ্বমানের রিপোর্ট বলব।

ডয়চে ভেলে: অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। তা কি বেড়েছে? আইন কি সহায়ক?

মুস্তাফিজ শফি: আমি একবাক্যে সহায়ক বলব না। আইনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। ২০১৮ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়েছে। এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একদিকে আমাদের স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আবার অন্যদিকে আমি বলব, এই আইনটির কারণে আমরা অনেক বেশি দায়িত্বশীল হয়েছি। আরও সতর্ক হয়েছি। ফলে এই আইনটির পরও যারা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করছেন, তারা সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা আরও বেশি পালন করে এগিয়ে যাচ্ছেন।

ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে কি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ঝুঁকি বেশি?

মুস্তাফিজ শফি: বেশি আমি বলব না। ঝুঁকি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় সব সময়ই ছিল। ভবিষ্যতেও যে থাকবে না তা আমি বলব না। বৈশ্বিক যে ঝুঁকি সেই তুলনায় বাংলাদেশে ঝুঁকি কম বলে আমি মনে করি। কারণ বাংলাদেশে তো যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা করতে হচ্ছে না।

১৯৭২ সালের ১৭ জুন ওয়াশিংটনের ওয়াটারগেট ভবনে ডেমোক্রেটিক পার্টির জাতীয় কমিটির সদর দপ্তরে পাঁচ ব্যক্তি অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে একজন সিআইএর সাবেক কর্মকর্তা জেমস ম্যাকর্ড। ঘটনার সময় তিনি প্রেসিডেন্ট নিপনের দ্বিতীয় দফা নির্বাচনী প্রচারণার জন্য গঠিত সংস্থায় নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছিলেন বলে ১৯ জুন জানায় ওয়াশিংটন পোস্ট। তবে নিপনের রি-ইলেকশন ক্যাম্পেইন প্রধান জন মিচেল তা অস্বীকার করেন।

ডয়চে ভেলে: এর বাইরে আর কোনো ঝুঁকি এখানে আছে কিনা...

মুস্তাফিজ শফি: আমি আইনের বিষয়টি আবারও বলতে চাই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিন্তু আমরা বিরোধী নই, আইনটির প্রয়োজন আছে। কিন্তু সম্পাদক পরিষদের যে স্ট্যান্ড, এই আইনে কিছু নিবর্তনমূলক ধারা আছে। সেগুলোতে স্বাধীন সাংবাদিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আমরা মনে করেছি। সেই মনে করাকে এখনও আমি মনে করি সঠিক। ওই ধারাগুলোকে বাতিল ও সংশোধন করে সাংবাদিকতা-সহায়ক করা উচিত। আরেকটি ঝুঁকি আছে। বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্পে এখন বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপ বিনিয়োগ করেছে। তাদের পত্রিকায় সাংবাদিকদের কিছুটা হলেও সেলফ সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয়।

ডয়চে ভেলে: প্রতিষ্ঠানগুলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় আগ্রহী? তারা কি বিনিয়োগ করে?

মুস্তাফিজ শফি: আগ্রহ নেই সেটা নয়। কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের তো সেলফ সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এটা শুধু আমার পত্রিকার কথা বলছি না। আমি এখনকার পরিবেশের কথা বলছি। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরাও এখন পত্রিকার মালিক। অনেক এমপি আছেন পত্রিকার মালিক। ফলে তার দলের সুবিধা-অসুবিধা তাকে দেখতে হয়। তার দলের বিরুদ্ধে রিপোর্ট হলে তিনি তার পত্রিকার সাংবাদিকদের সেটা দিতে নিরুৎসাহিত করেন।

ডয়চে ভেলে: সংবাদমাধ্যমের ভেতরেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ শক্তি রয়েছে বলে মনে হয়?

মুস্তাফিজ শফি: সেটা আমার পত্রিকায় নেই। অন্য কারও আছে কিনা আমি বলতে পারব না। কিন্তু আমি যখন চিন্তা করি, তখন আমার পত্রিকায় যারা বিনিয়োগ করছেন, তাদের স্বার্থটাকে আমার মাথার মধ্যে নিই। কিন্তু এখানে একটি উদাহরণ দিতে চাই, ওয়ান ইলেভেনের সময়, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও কিন্তু ‘সমকাল’ রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলেছে।

ডয়চে ভেলে: এমন কী ঘটেছে যে, রাষ্ট্রীয় শক্তি কখনও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপতে বাধা দিয়েছে বা ছাপতে দেয়নি বা অনুসন্ধান শুরুই করা যায়নি? আপনার অভিজ্ঞতা কী?

মুস্তাফিজ শফি: আমরা অনেক সময় পার করে এসেছি। আমরা স্বৈরশাসনের সময়ে ছিলাম। আমি ‘৯০-এর আগের কথা বলছি। সেই সময়ে সাংবাদিকতা কেমন ছিল, তা আমরা সিনিয়রদের কাছ থেকে জানি। তার পরবর্তী যে সময়টি, তার অবস্থা আমি বলব, ওই সময়ের চেয়ে ভালো। তার পরে সেনা সমর্থিত সরকার পার হয়ে আমরা এখন গণতান্ত্রিক সরকারে বাস করছি। আমি জোর দিয়ে বলছি, যারা পত্রিকার মালিক তারা ব্যবসা করবেন, কিন্তু তারা যদি রাজনীতি করেন, তাহলে স্বাধীন সাংবাদিকতা বিঘ্নিত হয়।

ডয়চে ভেলে: কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার মতো প্রতিবেদন করে না বা করতে সাহস করে না...

মুস্তাফিজ শফি: আমি ওইভাবে তুলনা করতে চাই না। আলজাজিরা যে বিষয়টি বলছে, ওটা তো বিতর্কিত একটি বিষয়। প্রতিবেদনটির গঠন প্রক্রিয়া নিয়েও কিন্তু অনেক বিতর্ক আছে। বলা হচ্ছে, দুই বছর ধরে অনুসন্ধান করা হয়েছে কিন্তু দেখবেন অনেক গ্যাপ। দুই বছর অনুসন্ধানে, একটি প্রোপাগান্ডা তো দুই বছরের অনুসন্ধানী রিপোর্ট হিসেবে প্রচার হতে পারে না।

ডয়চে ভেলে: সাংবাদিক, বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকের জন্য কোনো সুরক্ষা আইন বা রাষ্ট্রের কোনো সহায়তার দরকার আছে কিনা?

মুস্তাফিজ শফি: আমাকে কেউ আলাদাভাবে সুরক্ষা দেবে, এটা আমি মনে করি না। আমি মনে করি, আমার বিরুদ্ধে যে আইনগুলো আছে, যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে নিবর্তনমূলক ধারাগুলো আছে, সেগুলো যদি বাতিল হয়, তাহলে আমার সুরক্ষা আমি নিতে পারব। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের অনেক আইন আছে। প্রেস কাউন্সিল আইন আছে, ফৌজদারি আইন আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিককে কেন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে? সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোনো নিবর্তনমূলক আইন থাকবে না, সেটাই আমার সুরক্ষা। এই সুরক্ষা আমি চাই রাষ্ট্রের কাছে, সরকারের কাছে।

ডয়চে ভেলে: বর্তমান সরকার কি সাংবাদিকতার কোনোভাবে গলা চেপে ধরছে বা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে নানা কৌশলে আটকে দিচ্ছে?

মুস্তাফিজ শফি: আমি ঠিক এটাকে এভাবে দেখতে চাই না। সবসময়ই ক্ষমতাসীনরা কিন্তু সাংবাদিক, সংবাদমাধ্যমকে শত্রু মনে করেছে। সেটা জাতীয় পার্টি বলেন, স্বৈরশাসন যখন ছিল তখন বলেন বা পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকার এসেছিল, আওয়ামী লীগ সরকার এসেছিল, আবার বিএনপি, এখন আবার আওয়ামী লীগ সরকার। সবার এই জায়গায় মানসিকতা কিন্তু প্রায় কাছাকাছি। তারা মনে করেন, তাদের কোনো মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে রিপোর্ট গেলে বোধ হয় তাদের পুরো দলের বিরুদ্ধে রিপোর্টটি চলে গেছে, পুরো সরকারের বিরুদ্ধে রিপোর্টটি চলে গেছে। এটা আমাদের রাজনীতির একটি প্রবণতা। এটা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপি নয়, সবার।

ডয়চে ভেলে: অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কেন প্রয়োজন? দেশের মানুষ, রাষ্ট্র, সরকারকে কি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কোনো সহায়তা করতে পারে?

মুস্তাফিজ শফি: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। কেন বলা হয়? আসলে এই গণমাধ্যমই চোখ খুলে দিতে পারে সবকিছুর। সেই জায়গায় কেউ যখন সরাসরি ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্ত হন, তখন মনে করেন, এটা বোধ হয় তার সরকারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, তার দলের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। কিন্তু ভুল সংশোধন করার জন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দরকার। আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না যে কী হচ্ছে, সেই জায়গাটিতে সংবাদপত্র ধরিয়ে দেবে আপনাকে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে স্বাধীন সাংবাদিকতা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা খুবই জরুরি বিষয়। এটা যদি কেউ ব্যাহত করার চেষ্টা করেন, বুঝে হোক আর না বুঝে হোক তিনি গণতন্ত্রেরই ক্ষতি করছেন।