- চতুরঙ্গ
- বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির আন্দোলন
বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির আন্দোলন

"নানান দেশের নানান ভাষা।/বিনে স্বদেশীয় ভাষা,/পুরে কি আশা?/কত নদী সরোবর কিবা ফল চাতকীর/ধারাজল বিনা কভু/ঘুচে কি তৃষা?- রামনিধি গুপ্ত মনের কথা বলেছেন প্রাণের ভাষায়। পাকিস্তানিরা শুধু বাংলা ভাষা নয়, অক্ষরও মুছে দিতে চেয়েছিল। ১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করেন। ১৯৪৮ সালে আয়োজিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব নেওয়া হলে সভাপতির অভিভাষণে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বিরুদ্ধাচরণ করে বলেন, 'আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়; এটি একটি বাস্তব কথা।'
যৌক্তিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ৬১ ভাগেরও অধিক পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি এবং তাদের শতকরা ৯৯ জনেরও অধিক বাংলাভাষী। তথাপি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেছিলেন, পাকিস্তান হচ্ছে মুসলিম রাষ্ট্র এবং মুসলমানের জাতীয় ভাষা উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চে ঢাকার রেসকোর্স মায়দানে ঘোষণা দিলেন, 'Urdu and only Urdu shall be the state language of Pakistan'. প্রতিবাদ করায় গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পুনরায় ২৪ মার্চ সেই একই ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করেন কার্জন হল সমাবর্তন অনুষ্ঠানে।
ছাত্রদের 'নো' 'নো' প্রতিবাদ উচ্চারিত হলে থমকে যান জিন্নাহ! ইত্যবসরে ১৯৫০ সালে গণপরিষদে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব উপস্থাপিত হলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রতিবাদ করে বাংলা ভাষাকে পাক-পরিষদের অন্যান্য ভাষার সঙ্গে সমানাধিকার দানের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পরে ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন আবারও উচ্চারণ করেন- একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এর ফলে পূর্ববঙ্গে শুরু হলো দ্বিতীয় দফায় বাংলা ভাষা আন্দোলন। এর চরম পর্যায় হচ্ছে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র মিছিলের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ। বুলেটের আঘাতে ভাষাবীর সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউরসহ শহীদের রক্তে রঞ্জিত হলো রাজপথ। গণদাবির মুখে পাকিস্তানের রাষ্ট্রতন্ত্র ১৯৫৬ সালে শাসনতন্ত্রে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত দেয়।
পাকিস্তানিরা শুরু থেকেই বাংলা ভাষা, সাহিত্যে ও সংস্কৃতির হাজার বছরের ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে। এর একমাত্র নিয়ামক শক্তি হিসেবে সামনে তুলে ধরে ধর্মকে। রবীন্দ্রনাথ ও তার সাহিত্যের ওপর আসে সাম্প্র্রদায়িক আঘাত; তাকে চিহ্নিত করা হয় হিন্দু কবি হিসেবে। এই 'হিন্দুয়ানি'র অভিযোগ তুলে নজরুলের কবিতা থেকেও 'হিন্দুয়ানি' শব্দ বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বড় রকম বিতর্ক দেখা দিয়েছিল ১৯৬১ সালে। বিশ্বব্যাপী রবীন্দ্রশতবর্ষের আয়োজন হচ্ছে, কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা স্বদেশে তা করতে দেয়নি। তখন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় লেখা হয়, 'রবীন্দ্রনাথ হিন্দুদের কবি। বলা হলো পাকিস্তানকে নির্মূল করে দুই বাংলাকে একীভূত করার ষড়যন্ত্র চলছে।'
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ে রেডিও পাকিস্তান এবং পাকিস্তান টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মগুলোর প্রচার রহিত করা হয়। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের তথ্য ও বেতার মন্ত্রী খাজা শাহাবউদ্দিন জাতীয় পরিষদকে জানান, 'রবীন্দ্রনাথের গান আদর্শবিরোধী, তা প্রচার বেতার ও টেলিভিশনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে'। রবিঠাকুরের গান নিষিদ্ধের প্রতিবাদে আন্দোলনে বিরক্ত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন বাংলা বিভাগের প্রধান আব্দুল হাইকে রাগত স্বরেই বললেন- 'ধুর মিয়া আপনেরা খালি রবীন্দ্র সংগীত, রবীন্দ্র সংগীত করেন কে? আপনেরা নিজেরা রবীন্দ্র সংগীত লিখ্যা ফালাইতে পারেন না...?' হাই সাহেব বিনয়ের সঙ্গে মোনায়েম খানকে বললেন, "স্যার আমরা তো লিখতে পারি, কিন্তু আমি লিখলে তো সেটা 'রবীন্দ্র সংগীত' হবে না, হবে 'হাই সংগীত'।"
১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হামুদুর রহমান আরবি হরফে বাংলা ও উর্দু লেখার সুপারিশ করলে সেটার তীব্র প্রতিবাদ জানান বুদ্ধিজীবীরা। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের সংহতি বৃদ্ধির অজুহাতে রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করা হলে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ এই ভাষা সংস্কারের কঠোর প্রতিবাদ জানান। ফলে বাঙালির মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে এবং এই অবিচারের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করে। সরকারি বাধা উপেক্ষা করে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে রবীন্দ্রশতবর্ষ উদযাপন, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সন্জীদা খাতুনের উদ্যোগে 'ছায়ানট' গঠন, বিশেষ করে প্রত্যেক রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নির্দেশে 'আমার সোনার বাংলা' সংগীত পরিবেশন, জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিকাশে সাহায্য করেছিল তুমুলভাবে। তাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলেই জনগণ ধীরে ধীরে নিজেদের দাবি ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে যা পরে রাজনৈতিক আন্দোলনে একীভূত হয়। রূপ নেয় মুক্তি সংগ্রামের, অর্জিত হয় স্বাধীনতা!
মুখের ভাষার জন্য যারা বুকের রক্ত ঢেলে দিল সে ভাষাশহীদদের নাম কি আমরা জানতে পেরেছি? বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করে যারা বাংলার বুলি দিয়ে গেলেন সে ভাষাসৈনিকদের নাম কি আমরা শুনেছি? সহজ উত্তর 'না'! তবে এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে ২০১০ ও ২০২০ সালে দুটি রিট মামলা দায়ের করা হয় এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হিসেবে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। ২০১০ সালে একটি রিট মামলায় হাইকোর্ট সব ভাষাশহীদ ও ভাষাসৈনিকদের নামের তালিকা প্রস্তুত ও রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদানের নির্দেশনাসহ চূড়ান্ত রায় প্রদান করেন। ওই নির্দেশনা মোতাবেক সরকার ২০১২ সালে ৬৮ জন ভাষাসৈনিকের নামের তালিকাসহ একটি গেজেট প্রকাশ করে। কিন্তু ভাষাসৈনিক ও ইতিহাসবিদদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি এবং বাংলা একাডেমি অভিমত ব্যক্ত করে, দীর্ঘ ৬০ বছর পর একটি প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা সম্ভব নয় বিধায় তা বাতিলের সুপারিশ করলে সরকার সেই গেজেট প্রত্যাহার করে নেয়। তবে আশার আলো এই, ২০২০ সালে আরও একটি রিট পিটিশন মামলায় হাইকোর্ট ভাষাশহীদ ও ভাষাসৈনিকদের নামের তালিকা প্রস্তুতের নির্দেশনা প্রদান করলে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে পুনরায় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে জানা যায়।
ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আমাদের সন্তানরা ইংরেজিতে কথা বলে শুধু সসম্মানিতই নয়, বাংলা বলতে না পারলে গর্বিত মনে করে। সাম্প্রতিক সময়ে সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর আগ্রহ সমাজের সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম কার্যত ইংরেজি। অপরদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের মূলধারার শিক্ষা হলেও ইংলিশ ভার্সন চালু হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে ৩নং অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলার কথা বলা থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ উচ্চ আদালতেও নেই। আর উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়নি বাংলায় ভালো কোনো বইপত্র পাওয়া যায় না বিধায়। বিলেতে প্রত্যক্ষ করেছি আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীরা অন্য দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পিছিয়ে পড়ার এবং কর্মক্ষেত্রে সুযোগের অভাবের মূল কারণ ইংরেজি ভাষা ও প্রযুক্তিবিষয়ক দুর্বলতা। তাই ইংরেজি মাধ্যমে পড়াটা দোষের নয়। এ ক্ষেত্রে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর দায়িত্ব হবে যদি তাদের শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষায়ও পারদর্শী হতে পারে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমনটি বলেছেন- 'আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন।'
সমগ্র পৃথিবীতে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে বাঙালিরা যে সংগ্রাম করে এসেছে, তার স্বীকৃতিস্বরূপ ২১ ফেব্রুয়ারি সেই রক্তস্বাক্ষরিত দিনটি আজ 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'। এই গৌরব বাঙালির ছাড়া পৃথিবীর অন্য কারও নেই।বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তির আগ্রাসনে মাতৃভাষা ও সাহিত্যচর্চা যেন হারিয়ে না যায় এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।
মন্তব্য করুন