ভাষা হচ্ছে মনের ভাব প্রকাশ করার সবচেয়ে উত্তম একটি মাধ্যম। শুধু মানুষই ভাষা ব্যবহার করে না; পৃথিবীতে যত প্রাণী রয়েছে সবারই নিজস্ব ভাষা রয়েছে এবং তারা সবাই তাদের জাত, ধর্ম এবং গোত্রের মধ্যে নিজস্ব ভাষাতেই কথা বলে। বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের গর্ব-অহংকার। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে পাকিস্তানি শাসক বাংলা ভাষাকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে এসেছে, কিন্তু পারেনি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্য আন্দোলনকারী কয়েকজন মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত, শফিকসহ আরও অনেকে। পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ভাষা আন্দোলন থেকেই জাগ্রত হয় জাতীয় চেতনা। আর এরই ফলস্বরূপ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয় দেশ। তাই বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার ও প্রচলন নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৮৪ সালে এক নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছিল, 'সব সাইনবোর্ড এবং গাড়ির ফলক বাংলায় হতে হবে। তবে কেউ প্রয়োজন মনে করলে নিচে ছোট করে ইংরেজিতে লিখতে পারবে।' এটা সত্য যে, গাড়ির নম্বরফলক এখন প্রায় একশ' ভাগই বাংলায় হয়ে গেছে। কিন্তু সাইনবোর্ড লেখার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। ছোটখাটো দোকান, হোটেল বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বাংলায় সাইনবোর্ড দেখা গেলেও অভিজাত হোটেল, রেস্তোরাঁ, বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা শিল্প কারখানার সাইনবোর্ড এখনও ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে। অনেকেই মনে করেন, আইন ও জরিমানার মাধ্যমে এই অনিয়মের অবশ্যই পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। সংবিধানেও বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের ভাষা 'বাংলা'। সচিবালয়সহ সরকারি অধিদপ্তরগুলোতে বাংলার ব্যবহার অনেকাংশে চালু হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যবহূত হচ্ছে ইংরেজি।

বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের দেশে এখন আরেকটি সমস্যা হচ্ছে। তা হলো, এখানে বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে এক অদ্ভুত ভাষা তৈরি হচ্ছে। আমাদের দৈনন্দিন কথোপকথনে এখন সম্বোধন হিসেবে 'ব্রো' (ভাই), 'সিস' (বোন), 'মেট' (বন্ধু) ইত্যাদি শব্দ বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ হচ্ছে ভাষাদূষণ। শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছিলেন- 'ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী'। তার মতে, বাংলাদেশে নদীদূষণ এবং ভাষাদূষণ দুটোই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এবং ক্রমাগত বাড়ছে। যে ভাষার জন্য আমাদের পূর্বসূরিদের রক্ত দিতে হয়েছে, যে ভাষার জন্য জীবনবাজি রেখে আন্দোলন করে রফিকরা শহীদ হয়েছেন- আমরা কি সেই বাংলা ভাষাকে, বাংলা ভাষার চর্চা আদৌ সঠিকভাবে করতে পেরেছি? বর্তমান বানানরীতি নিয়েও রয়েছে নানা সমস্যা। বাংলা বানানের ভুল প্রয়োগ চলছে। এই বানানের কারণে অনেক শব্দের অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়। অন্যদিকে, বাংলার সঠিক উচ্চারণেও রয়েছে অনেক সমস্যা। নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য এসবই দুর্ভাগ্য এবং লজ্জাজনক।

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। পৃথিবীর কোথাও এমন মধুর ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে না- এ কথা অনেক কবি-সাহিত্যিকও বর্ণনা করেছেন তাদের লেখায়। শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, ভাষাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। জ্ঞান অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিকে রপ্ত করতে হলেও আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকেই আমাদের প্রাধান্য দিতে হবে। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে আমরা জ্ঞান অর্জন করতে পারি, কিন্তু আমাদের মনের ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম অবশ্যই বাংলা। বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য এর সঠিক ব্যবহার এবং প্রচলন অবশ্যই দরকার। বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য আমাদের ইচ্ছাটাই প্রধান। আমাদের আইন আছে, সুযোগও আছে। তারপরও আমরা বাংলাকে অবহেলা করি, বাংলার চেয়ে অন্য ভাষার প্রাধান্য বেশি দিয়ে থাকি। প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে- কেন মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে অকারণেই চলছে দূষণ ও অন্য ভাষা ব্যবহারের ছড়াছড়ি?

বছর ঘুরে আবার এসেছে ফেব্রুয়ারি মাস। আমাদের ভাষার মাস, আবেগের মাস। শুধু এ মাসটি এলেই আমরা বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করার অঙ্গীকার করি এবং ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। এর পর আবার যেমন চলছিল তেমনি চলে। প্রশ্ন হলো- বাংলা ভাষাকে সঠিকভাবে ব্যবহার না করা, বাংলাকে অবহেলা কিংবা অন্য ভাষার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ আমাদের কি আদৌ সঠিক পথে নিয়ে যাচ্ছে?