সপ্তাহের বাজার-সদাই থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ, দূরভাষ, কম্পিউটার, টেলিভিশন, এমনকি বড়পর্দার চলচ্চিত্রও ঢুকে গেছে হাওয়ার দুনিয়ায় ওরফে অনলাইনে। এ যেন 'সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে'। বিশেষ এই অবস্থাকে বলা হচ্ছে প্রযুক্তির অভিসৃতি বা ইংরেজিতে টেকনোলজিক্যাল কনভারজেন্স। নানান দেশের নানান ভাষা, কিন্তু প্রযুক্তির ভাষা একই- শূন্য আর এক। এই দ্বিমূল ভাষার ভেতর দিয়ে প্রকাশের একমাত্র উপায় নিজেদের ভাষা ও ভাষার সজ্জাকে যন্ত্রবান্ধব করে তোলা। ইউনিকোডের মাধ্যমে বাংলা ভাষা এখন অনেকটাই যন্ত্রবান্ধব বা বলা যায় অনলাইনবান্ধব, তবে সর্বক্ষেত্রে নয়। সেই সুবাদে এখন আমাদের দেশে তো বটেই, গোটা দুনিয়াতেই বাংলা ভাষায় প্রচুর অনলাইন পোর্টাল রয়েছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, ভিত্তিমূলে যে ভাষা দিয়ে আমরা এসব সাইট নির্মাণ করি, ধরি, হাইপারটেক্সট মার্কআপ ল্যাংগুয়েজের (যঃসষ) কথা; সেগুলো কিন্তু আমাদের ইংরেজিতেই লিখতে হচ্ছে।

আন্তর্জালিক দুনিয়ার সম্মুখ-জানালায় বাংলাকে কিছুটা যন্ত্রবান্ধব করার কারণে অনলাইন পোর্টালের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবেও আমরা বাংলায় লিখতে পারছি, এটা ঠিক। ঘটনা হলো, এই বাংলা সুসম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয় না। হাতেগোনা কয়েকটি অনলাইন পোর্টাল ও গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া বাংলার ব্যাপারে অনীহাই চোখে পড়ে বেশি। ভুল বানান ও অশুদ্ধ বাক্য দেখে মন খারাপ হলেও আদতে কিছু করার নেই। কারণ প্রযুক্তি স্বাধীনতা দিয়েছে। তার হাত ধরে স্বেচ্ছাচারিতাও প্রবেশ করেছে। এর বড় কারণ আছে নিশ্চয়; সেই আলাপেই আমরা প্রবেশ করতে চলেছি।

অজস্র অখ্যাত অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম দেখলে পিলে চমকে ওঠে। ভুল বানান তো আছেই, তার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে থাকে অযথা সুড়সুড়ি, ভুয়া খবর, এমনকি বিভ্রান্তিকর শিরোনাম বা ক্লিকবেইট। মোটামুটি চেনাজানা পোর্টালেও ভাষার প্রতি অযত্নের ছাপ দেখা যায়। আর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের কথা বলা বাহুল্যই বটে। প্রযুক্তির কারণে সবাই যেহেতু প্রকাশিত হতে শিখে গেছেন, তাই সবাই যার যার মতো নিজের মত-দ্বিমত প্রকাশ করছেন। পরিতাপের বিষয়, কেউ ভাষাটা শেখার আগ্রহ বোধ করছেন না। এর কারণ আর কিছু নয়, আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের উদাসীনতা। বাংলা মাতৃভাষা বলেই যেন এটি সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। আমাদের নজর ইংরেজির দিকে, যেহেতু ইংরেজি জানলে ভালো মাইনের চাকরি পাওয়া যায়। এমনকি দেশের বাইরে গিয়েও সুবিধা করা যায়। কিন্তু এতে যে গোলামি ঘুচবে না, তা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। বাংলা ভাষায় যে এখন উল্লেখ করার মতো দর্শনচর্চা হয় না; জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখা নিয়ে গবেষণাপত্র হয় না; তার প্রধান কারণ মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা।

ইংরেজি বা ইউরোপীয় ভাষায় যারা কথা বলে বা লেখালেখি করে হালে অভ্যস্ত, তারা বলতে পারেন- বাংলা ভাষা জানায় কোনো গৌরব নেই বা এই ভাষায় দর্শনের বই লেখা যায় না; বিজ্ঞানের শব্দাবলি ধরা যায় না; যন্ত্র চালনার নির্দেশনা তৈরি করা যায় না ইত্যাদি। প্রশ্ন হলো, দর্শন, বিজ্ঞান সবকিছু কি ইংরেজদেরই তৈরি করা? দর্শন ও অঙ্কশাস্ত্রের পেছনে আরব ও ভারতবর্ষের অবদানের কথা তো ইতিহাসে উজ্জ্বল; তা কি আমরা আমলে নেব না? ইংরেজরা তো ঠিকই অন্যদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছে এবং এখনও করে চলেছে। ধারণ ও আত্মীকরণের সব ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমরা কেন বাংলা ভাষাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি? এর উত্তর রয়েছে গোলামি মনোবৃত্তিতে। মানসিক এই গড়নের প্রভাব তাই বিস্তৃত হয় ডিজিটাল দুনিয়াতেও।

আমরা ইউনিকোডে বাংলা লিখছি ঠিকই, কিন্তু যন্ত্র পরিচালনার ভাষা এখনও বিদেশিই রয়ে গেছে। যেমন আমাদের কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ, লিনাক্স বা ম্যাক-ওএস এগুলো কিন্তু ইংরেজিতেই। আমরা কি চাইলে বাংলায় প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ তৈরি করার উদ্যোগ নিতে পারতাম না? চাইলে সবই করা যেত। কম্পিউটার পরিচালনার সফটওয়্যারও বাংলায় তৈরি করতে পারতাম। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন হাজার হাজার নানা প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার ও অ্যাপলিকেশন আমরা ব্যবহার করি, সেগুলোর ৯৯ ভাগই ইংরেজিতে। দেশীয় উদ্যোগে কিছু কিছু বাংলায় হয়েছে, তা অপ্রতুল। ডিজিটাল বাংলাদেশ ডিজিটালি অনেক দূর এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমার মনে হয়, গোড়ায় বড় ধরনের গলদ থেকে যাচ্ছে। গলদ ঠিক নয়; বলা ভালো, গোলামি মানসিকতা থেকে গোলাম করে রাখার মানসিকতাই মূল কারণ।

ফরাসি ভাবুক মিশেল ফুকোর ঋণ স্বীকার করে বলা যায়- প্রাতিষ্ঠানিক ও শাসনতান্ত্রিকভাবে, শিক্ষায় এবং জ্ঞানকাণ্ডে ইংরেজি বিস্তারের মাধ্যমে সামাজিক স্তরে ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তার রাখার কৌশলেরই চর্চা হচ্ছে। এর নাম ফুকো দিয়েছিলেন উরংঢ়ড়ংরঃরভ; উপনিবাস আর নেই ঠিকই, কিন্তু মনের খোঁয়াড় থেকে বেরুতে না পারায় চিন্তার কাঠামো আগের মতোই রয়ে গেছে। বলা যায়, ইংরেজদের জায়গায় দেশি সাহেব-ম্যামরা ক্ষমতায় বসেছেন মাত্র। এ কারণেই ইংরেজির এত কদর। অফিস-আদালত থেকে শুরু করে শিক্ষার মাধ্যম পর্যন্ত, এমনকি আমরা চৌদ্দ আনা ডিজিটাল হয়ে যাওয়ার পরও আমাদের সাইবার দুনিয়ার সাড়ে পনেরো আনা এখনও ইংরেজিতে। আমার প্রশ্ন হলো- চীন পারল কী করে ইংরেজিকে বুড়ো আঙুল দেখাতে? বলবেন, অর্থনীতি বড় চালিকাশক্তি। কিন্তু বাংলাদেশও তো বসে নেই, মধ্যম আয়ের ক্লাবে প্রবেশ করেছে সে! তারপরও কেন মাতৃভাষা বাংলা অবহেলার শিকার? সলিমুল্লাহ খান একে বলেন 'বিকৃতকাম'। বিদেশি ভাষার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করে রক্ত দিয়েছি। সেই দিনটি এখন ভাষাশহীদ দিবস থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা সেধে সেধে পরাধীন হচ্ছি আরেক বিদেশি ভাষার কাছে। এটা বিকৃতিই বটে। সলিমুল্লাহ খান মনে করেন, মাতৃভাষা ব্যতিরেকে বিদেশি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করা 'বিকৃতকামে'র নামান্তর। ফ্রয়েড যে অর্থে বিকৃতকামকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, ঠিক সেই অর্থে নয়। ফ্রয়েড থেকে কিঞ্চিৎ সরে এসে লাকাঁ যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেটাই তিনি গ্রহণ করেছেন। প্রকৃতি থেকে সংস্কৃতিতে পৌঁছানোর পথে বাধা প্রদান করাই 'বিকৃতকাম'।

বাস্তব থেকে বায়বীয় বা সাইবার দুনিয়ায় বাংলা ভাষার যে দুরবস্থা দেখি, তা উভয় অর্থেই- প্রয়োগ ও অবস্থান; সেটি ওই বিকৃতকামেরই জের মাত্র। নয়তো মাতৃভাষাকে ছুড়ে ফেলে ভিনদেশি ভাষাকে মুখে তুলে নিয়ে জ্ঞানচর্চার ভান করি কেন? অন্য ভাষা শেখা অন্যায় নয়, তবে মাতৃভাষাকে হেলাফেলা করলে নিজের সংস্কৃতি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। মাথা ঠিক থাকলে হাত-পাও ঠিকঠাক কাজ করে। আমাদের মাথায় গণ্ডগোল। আমরা বুঝতে পারি না, ইংরেজি আমাদের কেজো ভাষা, ব্যবসাপাতি চালানোর ভাষা। কিন্তু বাংলা কোনোভাবেই দ্বিতীয় সারির ভাষা নয়। ১৯৫২ সালের ইতিহাস আমরা জানি; রবীন্দ্রনাথ যে মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন সেটা আমরা জানি; ইউরোপের দেশগুলোর নিজ নিজ ভাষায় উন্নয়ন সাধনের কথাও আমাদের অজানা নয়। কিন্তু এত জানা কোনো কাজেই আসছে না, জ্ঞানে পরিণত হচ্ছে না, শুধু 'ঞ' যুক্ত হচ্ছে না বলে। 'ঞ' বলতে আমি বোঝাতে চাইছি আমাদের সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কথা। এ দুটো বিষয় যোগ হলেই মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনচর্চার সম্পর্কিত জানা আমাদের জ্ঞানে পরিণত হতো। তখন বাস্তব ও অবাস্তব দুই জাহানেই মাতৃভাষার গুরুত্ব বাড়বে।
লেখক
প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক