আমাদের ব্যবহারিক জীবনে বাংলা ভাষার ব্যবহার প্রায় উঠে যাই যাই অবস্থায় পৌঁছেছে। বৃহত্তর নিরক্ষর, সাক্ষর, স্বল্পশিক্ষিত সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিদিনের সামাজিক বিনিময়ের ভাষা হিসেবে লোকভাষা ব্যবহার করেন। তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের ভাষা অভিন্ন। তাই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্ব-স্ব আঞ্চলিক বাংলা ভাষার স্বাভাবিক চলনটি বিদ্যমান। আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়, বৈদেশিক যোগাযোগ ইত্যাদি অপর ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে যাবতীয় যোগাযোগের ভাষা ইংরেজি। এবং এসব কাজে ইংরেজির ব্যবহার ঔপনিবেশিক কাল থেকেই প্রচলিত।

ভাষার সংকটজনক অবস্থা অন্যত্র বিরাজমান। শিক্ষিত মানুষের ভাষা ব্যবহারেই সমস্যাটি স্পষ্ট ও প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। তরুণতর বাংলাদেশি শিক্ষিতজন থেকে প্রৌঢ়ত্বের কোঠায় দাঁড়ানো বাঙালির ভাষা এক সর্বনাশা জটিলতায় সমাচ্ছন্ন। মৌখিক কথাবার্তায় ইংরেজি, হিন্দি, বাংলার মিশেলে তারা এক অদ্ভুত খিচুড়ি ভাষা ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর এক ভাষা যা তথাকথিত সামাজিক (যদিও তা সমাজ কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ) যোগাযোগমাধ্যমের ভাষা। সে ভাষা 'বর্ণ' 'শব্দ' 'চিহ্ন' প্রতীকের ভাষা। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ভাষাভাষীরা যদি ধীরে ধীরে শেষোক্ত ভাষাটিকেই তাদের প্রাত্যহিক সামাজিক প্রয়োজনে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নির্বাচন করে, তবে 'মান বাংলা' বলতে কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না। এবং সেই বিপর্যয়ের দিনে বাংলা ভাষার বিপন্ন অস্তিত্বের আদলটি কী হবে- সেটিই ভাবনার বিষয়। দ্বিতীয়ত, সমস্যাটি বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষার্থীদের ভাষা ব্যবহারে ভিন্নরূপে দৃশ্যমান।

প্রাইভেট স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর ফাঁদে বিদ্যার্থী ধরার রেওয়াজ আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সিংহভাগই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যা বিতরণ করেন। ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসেও তিনি ইংরেজি লেকচার শিট (হালে লেকচারের পরিবর্তে প্রশ্ন ও শিট দেওয়ার রেওয়াজ চালু আছে) বিতরণ করেন। ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কাট-পেস্ট পদ্ধতিতে তৈরি শিট পড়ে বিদ্যার্থীরা তাই উত্তরপত্রে উগরে দেন। ফলে প্রতিষ্ঠান বা সরকারের ঘোষণা ব্যতীতই শিক্ষার মাধ্যম হয়েছে ইংরেজি। সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় এসব তথ্য-তালাশের ধার ধারে না। অতএব, বিপন্ন গরিব ঘরের সন্তানটি। তিনি ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার সুযোগ পাননি, যত অপরাধ ও যন্ত্রণা তার। কারণ তিনি ওই ঔপনিবেশিক ভাষাটি ভালো জানেন না। আর এক সংকট কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের অজ্ঞতাজনিত।

সেদিন অনলাইন ক্লাসে একজন বিদ্যার্থী বলল, 'আমি বাংলায় কম্পোজ করবার পারি না, অ্যাসাইনমেন্ট কীভাবে পাঠাব?' তাকে বললাম, যেহেতু তুমি জার্মানিতে বসবাস করো, জার্মান ভাষায় লিখবে। মুখে ও-কথা বললেও কিন্তু তার সমস্যাকে খাটো করে দেখা যায় না। বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক আমি। বিদ্যার্থীর সমস্যা সমাধান করাই শিক্ষকের দায়িত্ব। তবে তাকে তো বলতেই হয়, তুমি ইংরেজিতে বাংলা পরীক্ষা দিও। আমার সমস্যা আর কারও জীবনকে স্পর্শ নাও করতে পারে; কিন্তু একে কি খাটো করে দেখব? না, তার উপায় নেই। নেই যে, তার পেছনে অনেক কথা বিস্তারে বলার অবকাশ এখানে নেই। এ-কথা অবশ্যই বলা যায়- এসব সমস্যার মূলে যান্ত্রিক কোনো কারণ আছে কিনা, তা সংশ্নিষ্ট বাঙালি বিজ্ঞানীই বলতে পারবেন। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় বিদ্যার্থীরা বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। তা নয় বলেই বর্ণমালার পরিস্কার স্পষ্ট জ্ঞান নেই। উৎপত্তিকাল থেকেই বাংলা ভাষায় সংযুক্ত বর্ণ; হ্রস্ব-ই; দীর্ঘ-ঈ; হ্রস্ব-উ, দীর্ঘ-ঊ; দন্ত- ন; মূর্ধ্য-ণ, য-ফলা, রেফ 'র্-', 'র-ফলা' তিনটি 'শ'ঘটিত সমস্যা বিদ্যমান। আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বাংলা একডেমি ইত্যাদি জাতীয় প্রতিষ্ঠান তা অবহিত। সব শিক্ষার্থীর হাতে ল্যাপটপ তুলে দেওয়ার আগেই উপরিকথিত প্রতিষ্ঠানের অবশ্যই এ সমস্যার একটি সুষ্ঠু সমাধান করা উচিত ছিল। বিজ্ঞানকে রোখা যাবে না। প্রগতির ধারা সচল রাখতে হবে। তার জন্য সর্বাবস্থায় প্রস্তুত থাকাই তো বেঁচে থাকা। এখানেই ভুল পাহাড় গড়েছে। প্রযুক্তি বিক্রেতা দেশের ফর্মুলা নিয়ে আমরা একবারও ভাবতে পারিনি, যে-সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা আমরা চালু করতে যাচ্ছি, তা মূলত 'উদ্দীপক' নামক পরিভাষার দাসত্ব। মানুষের সৃজনক্ষমতা স্বয়ংক্রিয় স্বভাবজ। না হলে পৃথিবীর সব বিজ্ঞানীই উদ্দীপিত হয়ে আইনস্টাইন হতেন। ইতোমধ্যে এ ব্যবস্থার ব্যবহারিক ফল আমরা পেতে শুরু করেছি। 'সৃজনশীল শিক্ষা'র নামে বর্ণ পরিচয় পর্যন্ত শিশুদের শেখানো হচ্ছে না। তাই 'কি-বোর্ডে' সব বর্ণ এবং 'কার' চিহ্নাবলি থাকার পরও বিদ্যার্থীরা বাংলা টাইপ করতে পারছে না। অর্থাৎ বাংলা ব্যঞ্জন ও স্বরবর্ণ, সংযুক্ত বর্ণ, কার-চিহ্ন ও ফলাদি, রেফ '-র্ ' চিহ্ন উত্তমরূপে শেখানো অত্যন্ত জরুরি। অভ্র সফটওয়্যার ব্যবহারে অভ্যস্ত বিদ্যার্থী এবং পরবর্তীকালের সব পেশার কর্মকর্তা-কর্মচারী শিক্ষিতজন বাংলা হরফে বাংলা না লিখে যদি ইংরেজি হরফে লিখে তবে তাকে দোষী করা যাবে কি?

নিত্যপ্রদর্শিত টেলিভিশন নাটক দেখলে বিপাকে পড়তে হয়। তাদের উচ্চকণ্ঠ সংলাপ-অভিনয় নারী-পুরুষের দাঁত-মুখ খিঁচানো ঝগড়ার স্মৃতিই স্মরণ করায়। এবং দেখতে দেখতে অভিনয়ের 'অ', শিল্পের 'শ মিলে 'অশিক্ষিত' নয়তো 'অশিষ্ট' শব্দ দুটিই তাদের উদ্দেশে ছুড়তে ইচ্ছে করে। মান্ধাতার কালের 'ঢাকাই ভাষা', নয়তো 'নোয়াখালী অঞ্চলে'র পুরাতন লোকভাষা কিংবা চলিত, সাধু, লোকভাষার খিচুড়ি হালের নাটকের সংলাপের ভাষা। আরও দেখা যাবে- নাটকের পণ্ডিত লেখক, শিক্ষিত অভিনয়শিল্পী সবাই যেন ভয়ংকর এক পাগলামি রোগে আক্রান্ত। পাগলামি না করে থাকতে পারছেন না কেউই। তাদের রোমান্টিক সংলাপগুলোও ঝগড়ার স্বরভঙ্গিতে তারস্বরে উচ্চারিত। এবং তারা যে কোন্‌ বাংলা ভাষায় কথা বলে, তা আবিস্কার করাও দুঃসাধ্য। আর এক দল ফতোয়াবাজের আবির্ভাব হয়েছে বাংলাদেশে। তারা সাহিত্য-শিল্পকলাকে সমাজবিজ্ঞানের সূত্র দ্বারা, মনোবিজ্ঞানের পরিভাষা দ্বারা বিচার করতে গিয়ে ধর্মীয় ফতোয়াবাজদের মতোই ইতোমধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। ভুলে যাওয়া অনুচিত, শিল্প-সাহিত্য সর্বাংশে সমাজবিজ্ঞান নয়। যতটুকু জীবনকে, জীবনের বিচিত্র অভিব্যক্তিকে উপস্থাপন করার জন্য প্রয়োজন, শিল্প-সাহিত্য অপর শাস্ত্রের ততটুকুই গ্রহণ করবে। সাহিত্যের শাস্ত্র রয়েছে তার নিজস্ব- যে-শাস্ত্র সমাজতত্ত্বের হাজার হাজার বছর আগে সৃষ্ট। সমাজতত্ত্বের দাসত্ব করতে গিয়ে শিল্প-সাহিত্য তাদের নিজস্ব গৌরবময় অস্তিত্ব বিসর্জন দেবে, এমনটি কেবল সভ্যতার গোধূলিমাখা অন্ধকারেই ভাবা যায়।

ভাষাবিভ্রাটের আর এক জগৎ সেলফোন। সেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বলে এক অদৃশ্য পৃথিবীর সমাজকে নির্দেশ করে, যার অবস্থান হাওয়ায়। সত্য-মিথ্যা, যুক্তি-প্রমাণ, ভুল-শুদ্ধ, ন্যায়-অন্যায় কর্মকাণ্ডের জন্য কোনো দায় নিতে হয় না। খাজনা-ট্যাক্সের কোনো বালাই নেই। 'লাইক শব্দ'টি সেখানকার 'এনআইডি'। সেই পৃথিবীর বাসিন্দাদের এক বাংলা ভাষা রয়েছে। সে বাংলা ইংরেজি হরফে লিখতে হয়। অথচ আমাদের পূর্বপুরুষেরা উর্দু হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবে অপমানিত বোধ করে রাজপথে নেমেছিল। সে ইতিহাস রক্তরঙে বাংলা ভাষায় লেখা। আজ আমাদের আত্মসম্মানবোধ বিলুপ্ত। যেন স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিকের কোনো আত্মসম্মানবোধ থাকতে নেই। প্রয়োজন নেই সুশক্ষিত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আত্মসচেতন যুগমানুষ হওয়ার। আমাদের অপকীর্তির ভয়াবহতা প্রতিদিনের সংবাদমাধ্যমে সর্বাধিক প্রচারিত বিষয়। অহিংস জাতীয়তাবোধ মানবতার জন্য কখনও ক্ষতিকারক কিছু নয়- বরং জাতীয় নেতৃত্বের বলিষ্ঠতায় তা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সংস্কৃতির উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো ভাষাকেও অপর শক্তির সমকক্ষ জ্ঞান করে। বাংলাদেশে ভাষা দারুণভাবে অবহেলিত। সংলাপে একটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে পারলে আমরা ধন্য মনে করি নিজেকে। বাঙালি আত্মঘাতী- সে তো পুরোনো কথা। কথা বললেই কথা বাড়ে। প্রকৃত সত্য এই, ভাষার সমৃদ্ধিকরণ কাজটি কার্যত ভাষাবিজ্ঞানীদের। 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট', বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ভাষাবিজ্ঞান বিভাগগুলো এবং বাংলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচল লোকভাষা সংগ্রহ করে নির্বাচিত শব্দগুলোকে অভিধানভুক্ত করলে বাংলাদেশের মানভাষা সমৃদ্ধ হতে পারে। উন্মোচিত করতে পারে নদীয়া-কৃষ্ণনগরের লোকভাষার সংস্কৃত রূপ প্রমথ চৌধুরীর সবুজ পত্রের কথ্যভাষার কবল থেকে সর্ববঙ্গীয় এক 'মানবাংলা' সৃষ্টির পথ। আধুনিক বাংলা ভাষার বিকাশে এরূপ পদক্ষেপ হতেই পারে সহায়। প্রত্যেক শিক্ষিতজনের নিজ ভাষা, মাতৃভাষার প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা থাকাও অতি জরুরি। ভাষার নিরাপত্তা বিধান করতে হবে ব্যবহারকারীকেই। কোরবানির চাঁদ দেখলেই গরু খোঁজার মতো ফেব্রুয়ারি মাস বা ভাষার মাস এলেই মাতৃভাষার জন্য মায়াকান্না করার কোনো অর্থ নেই; উপকৃত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। বাচ্চার অক্ষরজ্ঞান দানের সময় থেকেই ভাষার প্রতি তাকে শ্রদ্ধাশীল, যত্নশীল করে গড়ে তুলতে হবে। ঔপনিবেশিক মন আমাদের। বাচ্চা কথা বলতে শিখলেই তার মুখে ইংরেজি শব্দ তুলে দেন মা- তবে তো ওই শিশুর মাতৃভাষা ইংরেজিই হলো! শিক্ষিত মা বাংলা ভাষায় 'বাচ্চা' শব্দটি থাকা সত্ত্বেও 'বেবি' বলে নিজেকে সংস্কৃতিবতী মনে করেন। ইদানীং তরুণ সমাজে 'ভালোবাসি' শব্দের পরিবর্তে 'সে কমলকে লাভ করে'র মতো হাস্যকর ব্যবহার চালু রয়েছে। অর্থহীন স্মার্টনেস প্রদর্শনে এখন 'ভাত দাও' না বলে খেতে বসে 'রাইস দাও'; 'তরকারি' না বলে 'এই আর একটা কারি দাও এখানে' বলছি এবং তাতে বক্তা অহংকারও বোধ করেন। জীবনাচরণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এভাবেই প্রতিদিন ভাষা ধ্বংসের 'কভিড-১৯'এর জীবাণু প্রবেশ করছে। লেখ্যরীতির বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে হলে এসব সমস্যার জীবাণু ধ্বংস করার মতো প্রতিষেধক চই। জীবন বদলাবে, সংস্কৃতির শরীরে লাগবে রূপান্তরের ছোঁয়া, অথচ ভাষা বদলাবে না, তা হয় না- অনিবার্য, যা তাকে সবাই মিলে প্রয়োজনানুগ করাই যৌক্তিক; কথার কথা এটাই।
লেখক
প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ