- চতুরঙ্গ
- ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু
ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু

মায়ের ভাষা বাংলা রক্ষার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজপথে আন্দোলনে নামে বাংলার দামাল ছেলেরা। পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান বরকত-সালাম-রফিক-শফিক-জব্বারসহ নাম না-জানা কত শহীদ! তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ফিরে পাই আমাদের প্রাণের ভাষা, মায়ের মুখের বুলি, মধুর ভাষা বাংলা। পৃথিবীর বুকে এমন শ্রুতিমধুর বুলি রয়েছে কিনা জানা নেই।
ভাষা একটি জাতির যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। এটি শুধু চিন্তা-চেতনা, মনন ও মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমই নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশ ও জাতির আত্মপরিচয়। হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষা প্রকাশ করে যাচ্ছে বাঙালি জাতির অস্তিত্ব ও স্বকীয়তা। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ১৯৪৭ সালে ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে কোনো মিল না থাকার পরও শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে ১২শ মাইল ব্যবধানের দুটি পৃথক ভূখণ্ডকে এক করে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। অন্যদিকে শুধু ৭ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ কথা বলত উর্দুতে। সেই উর্দুকেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা করার জন্য জোর পাঁয়তারা শুরু করে। কিন্তু বাংলার মানুষ তা হতে দেয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় দেশভাগের পরপর কলকাতায় একটি অসাম্প্র্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল পিছিয়ে পড়া ও নিপীড়িত পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা। এর নেতৃত্ব দেন তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ওই সময় কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে বঙ্গবন্ধু সরাসরি যুক্ত হন ভাষা আন্দোলনে। গঠিত হয় তমদ্দুন মজলিস, এর পর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। ওই সম্মেলনে ভাষাবিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। এসব প্রস্তাব পাঠ করেন শেখ মুজিব। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলের তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, আবুল কাসেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুহসহ অন্য নেতারা। সভায় রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য অবিস্মরণীয় দিন। এ দিন ভাষার দাবিতে প্রথম হরতাল পালিত হয়। এটাই হলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম হরতাল। হরতালের নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান। ওই দিন তিনি পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এটি ছিল পাকিস্তানে কোনো প্রথম রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার। (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান :জীবন ও রাজনীতি, বাংলা একাডেমি)।
ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ১৯৪৯ সালে দু'বার গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিব। ওই বছরের অক্টোবরে তাকে আটক করে পাকিস্তান সরকার; মুক্তি পান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তবে জেলে বসে নিয়মিত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করতেন। ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন- '১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।' (গাজীউল হক, আমার দেখা আমার লেখা, পৃষ্ঠা-৪০)। একই কথা লিখেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। 'একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা' প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন।' (সূত্র :ভালোবাসি মাতৃভাষা- পৃষ্ঠা :৬২)।
ভাষা আন্দোলনের পর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলি বাংলায় চালু প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান আইন সভায় গর্জে ওঠেন এবং বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বীরোচিত ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধুসহ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ওই দিনও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জানান তিনি। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। এর পেছনেও বিশেষ অবদান রয়েছে বঙ্গবন্ধুর।
ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যেই সীমিত ছিল না। একুশের উৎস থেকে জেগেছিল গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন। সে স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে দানা বেঁধেছিল সংগ্রাম। স্বাধীনতা সংগ্রাম, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমাদের পথ দেখিয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি। তেমনি একুশ আজও পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ভাষার অধিকার অর্জনেও পথিকৃৎ হয়ে আছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলা ভাষায় সংবিধান প্রণয়ন করেন বঙ্গবন্ধু। এটিই একমাত্র দলিল, যা বাংলা ভাষায় প্রণীত। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রথম বাংলায় বক্তব্য দিয়ে বিশ্বসভায় বাংলাকে তুলে ধরেন। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মর্মবাণী ছিল- এর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিলেছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও আমরা সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে পারিনি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বাংলা চালু থাকলেও বাংলা এখনও উচ্চশিক্ষার বাহন হয়নি। আমাদের বহু ভাষাবিদ ও বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তাদের উৎসাহ দিতে হবে যেন বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। মিশ্র অর্থনীতির এই যুগে অবশ্যই বহু ভাষা জানা প্রয়োজন। তাই বলে সবার আগে নিজের ভাষাকে শুদ্ধভাবে বলতে ও লিখতে পারা গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত গৌরবের কাজ।
উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর
vcbsfmstu@gmail.com.
মন্তব্য করুন