ভাষা আন্দোলনের এই মাসে আমরা সবাই বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি ভাষাশহীদদের। বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে রক্ত ঝরানো শহীদদের প্রতি ২১ ফেব্রুয়ারির এই দিনে সারাবিশ্বের মানুষ শ্রদ্ধা জানায়। ভাষার জন্য জীবন দেওয়া একমাত্র জাতি হিসেবে বাঙালিদের এই ত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে বিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

স্বাধীনতার ৫০তম বছর ২০২১ সাল। ৫০ বছর আগে পাকিস্তানের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ। তারুণ্য নির্ভর এই দেশে এক অনুপ্রেরণার নাম ২১ ফেব্রুয়ারি। এই ভাষা আন্দোলন বিশ্বের সব জাতি থেকে আমাদের পৃথক করে দেয়। বিশ্বের প্রতিটি দেশে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয় এই ভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করে। আমাদের অনুপ্রেরণা যোগানো এই দিনটি চলতি বছর ভিন্নভাবে হাজির হয়েছে আমার সামনে। এতদিন জানা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে যে অসম্পূর্ণতা ছিল, তা পূরণ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে। এই প্রথম ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান ও কার্যক্রম সম্পর্কে আমি জেনেছি, গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’ অষ্টম পর্বে।

আমার মতো যারা চাচা চৌধুরী বা টিনটিন-এর মতো কমিকস পড়তে ভালোবাসেন, তাদের জন্য গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’ দুর্দান্ত এক বিষয়। বঙ্গবন্ধুকে জানা, বোঝা ও দেখার জন্য প্রতিবারই অপেক্ষা করে থাকি গ্রাফিক নভেলের নতুন পর্বের জন্য। কিন্তু এবারের পর্ব আমাকে বেশ অবাক করেছে। এতদিন যেই বঙ্গবন্ধুকে আমরা জেনেছি যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ছয় দফা আন্দোলন বা গণ-অভ্যুত্থানের জন্য; ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’ অষ্টম পর্ব।

বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে তৈরি গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’। আমরা শুনেছি ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ তার এ কথার প্রমাণ মেলে গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’-এর মাঝে। শৈশব থেকে নিজের কাছের মানুষগুলোকে রক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ও যুদ্ধের কথা যেন চোখের সামনে মেলে ধরে গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’। এর প্রতিটি পাতায় পাতায় রয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবনের অসাধারণ সব না জানা ঘটনা। জাতির পিতার প্রথম কারাবরণ থেকে শুরু করে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে সুপার হিরোদের মতো এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে ছুটে বেড়ানো!

এই ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’ আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। আসলে আমরা কতটুকু জানি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে? বঙ্গবন্ধুর জীবনের অসামান্য দলিল ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সালে কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দি হিসেবে থাকার সময় নিরিবিলি সময়ে আত্মজীবনী লিখেছেন তিনি। এটি প্রকাশ হবার আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জীবনের দীর্ঘ একটি অংশ সবার কাছে ছিল অজানা। এমনকি আমাদের স্কুলের বইগুলোতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ছয় দফা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বা মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদানের কথা উল্লেখ থাকলেও খুব অল্প কিছু তথ্য রয়েছে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর সক্রিয়তা নিয়ে।

তার থেকেও বড় বিষয় হলো, ভাষা আন্দোলনের বিষয়ে কখনই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি আগে। অথচ এই ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে তিনি ছিলেন সক্রিয়। আর সে কারণে তাকে আন্দোলনের শুরু থেকে দীর্ঘদিনের জন্য কারাগারে থাকতে হয়। ‘নিজের ভাষাকে নিজের রাষ্ট্রের ভাষা বানানোর দাবিও এখন অপরাধ?’- ভাষা আন্দোলনে পাকিস্তানের আচরণের সমালোচনা করে এভাবেই লিখেছেন বঙ্গবন্ধু, যা প্রকাশিত হয়েছে গ্রাফিক নভেলের অষ্টম পর্বে।

গ্রাফিক নভেলের ছবিগুলো আমাকে বেশি আকৃষ্ট করেছে। ‘বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করতে হবে’, ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ এমন সব প্ল্যাকার্ড নিয়ে তরুণদের রাজপথে নামার দৃশ্য যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর কার্যক্রম নিয়ে গ্রাফিক নভেলের আগে এমন তথ্য আর কোথাও প্রকাশ পায়নি। এই গ্রাফিক নভেল আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই ভাষা আন্দোলনের সময়ে, যখন রাজপথে চলছে তীব্র বিক্ষোভ।

আন্দোলনের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুকে কারাবন্দি করায় তিনি দুশ্চিন্তায় ছিলেন, কীভাবে আন্দোলন এগিয়ে যাবে। কীভাবে একটি রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষের মুখের ভাষাকে অবজ্ঞা ও প্রত্যাখ্যাত করতে পারে পাকিস্তানি শোষকেরা! কিন্তু এই দুশ্চিন্তার মধ্যেও আশার আলো দেখতে পান বঙ্গবন্ধু। কেননা জেলে বসে তিনি শুনতে পান মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাদে উঠে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে স্লোগান দিচ্ছে।

গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’ আমাকে শুরু থেকেই অবাক করে। কীভাবে একজন গ্রামের সাধারণ ছেলে হয়ে ওঠে অসাধারণ, কীভাবে স্কুলের সাধারণ এক বালক মানবসেবার জন্য হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব, অসাধারণ এক ঘটনাবহুল জীবন ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। আর সে কারণেই আমি ‘মুজিব’ গ্রাফিক নভেলের প্রতিটি পর্বের জন্য অপেক্ষা করে থাকি।