সমাজ ও রাজনীতিতে 'নেতা' বা 'নায়ক' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত অনেকেই। তবে, তারা প্রায় সবাই সমসাময়িক কালের নেতা, চলতি পারিপার্শ্বিকতার প্রেক্ষাপটের নায়ক। কিন্তু যুগ-যুগান্তরের পরিক্রমায় হাতে গোনা এক-আধজনই কেবল 'ইতিহাসের নায়ক' হয়ে উঠতে পারেন। ইতিহাস তার আপন তাগিদেই সেরূপ 'নায়কের' উদ্ভব ঘটায়। ইতিহাসের সেরূপ নায়করাই তখন হয়ে ওঠেন ইতিহাস রচনার প্রধান কারিগর ও স্থপতি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তেমনই একজন কালজয়ী পুরুষ।
একথা ঠিক যে, ইতিহাস রচনা করে জনগণ। তবে ইতিহাস নির্মাণে ব্যক্তির ভূমিকাও অস্বীকার করা যায় না। দল ও শ্রেণির সীমাবদ্ধতার মাঝে থেকেও একজন ব্যক্তি সেই সীমাবদ্ধতাকে খানিকটা পরিমাণে অতিক্রম করে, ও তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক মুহূর্তে ইতিহাসের চাহিদা অনুসারে অবদান রাখার মাধ্যমে, ইতিহাসের নায়ক হয়ে উঠতে সক্ষম হন। বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাস নির্মাণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেরূপ এক অনন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন।
একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, চূড়ান্ত বিচারে সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতাই একজন ব্যক্তিকে সৃষ্টি করে ও তাকে বিকশিত করে। যুগের বাস্তবতা একজন মানুষের বৈশিষ্ট্যের ও বিকাশের সীমা নির্ধারণ করে দেয়। শুধু তাই নয়, একজন ব্যক্তির চেতনাগত বিকাশও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়। এসব কথা যেমন সমাজের একজন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা একইভাবে প্রযোজ্য সমাজের 'মাথায়' যারা থাকেন তাদের ক্ষেত্রেও। সে হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। এর অর্থ অবশ্য মোটেও এটি নয় যে, মানুষ কেবল তার পারিপার্শ্বিক সমাজ ও দেশ-কালের বাস্তবতার অন্ধ নিয়ন্ত্রণে চালিত একটি যান্ত্রিক পুতুল মাত্র। ইচ্ছানিরপেক্ষ ঐতিহাসিক সীমা ও গণ্ডির মধ্যে থেকেও সে নিজ দায়িত্বে তার আপন জীবনকে পরিচালনা করে। এই সূত্রেই নির্ধারিত হয় কে বা কারা সমাজে যুগের 'মাথা' বা অগ্রনায়কের আসনে অধিষ্ঠিত হবে। শেখ মুজিবুর রহমানকে কেবল 'সমসাময়িক ইচ্ছানিরপেক্ষ বাস্তবতাই' বঙ্গবন্ধুতে রূপান্তরিত করেনি, তা তার নিজস্ব সাধনার ফল ও কৃতিত্বও বটে।
সব ধরনের দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত একজন 'বিমূর্ত বিশুদ্ধজন' হওয়া কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। মানুষ ফেরেশতা নয়। মানুষ মাত্রই হলো ইতিহাসের ফসল। এটি ইতিহাসেরই কথা। সমাজে একজন ব্যক্তির শ্রেণিগত অবস্থানের আলোকেই মূলত ইতিহাসে তার ভূমিকার সম্ভাবনা ও সীমা নির্ধারিত হয়। রাজনীতির ক্ষেত্রে, কোনো একজন নেতা বা কর্মীর ভূমিকা তার দলের চরিত্রের, এবং একটি দলের চরিত্র সেই দলের শ্রেণিভিত্তি দ্বারা নির্ধারিত গণ্ডির বাইরে যেতে পারে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।
বঙ্গবন্ধু আগাগোড়াই ছিলেন বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া শ্রেণিভুক্ত একজন জাতীয়তাবাদী নেতা। তবে, নানা দোদুল্যমানতা-দুর্বলতা সত্ত্বেও তার ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ এক পর্যায়ে অর্জন করেছিল র‌্যাডিক্যাল চরিত্র ও সুস্পষ্ট প্রগতিমুখীনতা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের ফলেই তা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু বিশেষ ক্রান্তিকালে এই প্রগতিমুখীনতা অর্জনের পেছনে ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ছিল এক অনন্য ও নির্ধারণমূলক ভূমিকা।
বঙ্গবন্ধুর ছিল একদিকে 'জনগণ মন অধিনায়কচিত' প্রবণতা এবং অপরদিকে তার শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতা। প্রতীকীভাবে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর অর্ধেকটা মন জুড়ে ছিল মজলুম জননেতা ভাসানী (তার সঙ্গে যুক্ত হয় কমরেড মণি সিংহ প্রমুখ) আর বাকি অর্ধেকটা দখল করে ছিল গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলে খ্যাত উদারনৈতিক বুর্জোয়া নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। একদিকের টান মজলুম জনতার দিক থেকে, অন্যদিকের টান বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া শ্রেণিস্বার্থ ও তার লক্ষ্য-আদর্শ-ভাবধারার দিক থেকে। এই 'দোটানা' নিয়েই বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়েছেন বাঙালি জাতিকে। এই 'দোটানাই' শেষ পর্যন্ত '৭৫-এর ট্র্যাজিক পরিণতি বয়ে এনেছিল।
বঙ্গবন্ধু মার্কসবাদী ছিলেন না। তিনি সব পক্ষকে খুশি রেখে চলতে চেষ্টা করেছিলেন। ফলে সবাই তাকে এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতা বলে মেনে নিলেও অন্য পর্যায়ে প্রায় সব পক্ষই তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিল। ১৫ আগস্টের কয়েক দিন আগে তিনি আমাকে বলেছিলেন, 'তোমার নেতারা আমাকে হত্যা করার চেষ্টা হতে পারে বলে সতর্ক করতে এসেছিলেন। আমি তাদের বলেছি, দাদা, আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। কোনো বাঙালি আমাকে গুলি করতে পারবে না। গুলি করতে গেলে তার হাত কেঁপে যাবে'। বঙ্গবন্ধু 'বাঙালি' বিষয়টিকে বুঝতে পারলেও 'শ্রেণি-দ্বন্দ্ব ও শ্রেণি-সংগ্রামের' বিষয়টি সেভাবে বুঝে উঠতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসাধারণ প্রজ্ঞাবান একজন নেতা। তিনি ছিলেন মানুষের লোক। মানুষের কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করতে পারতেন, বিচার-বিবেচনার রসদ সঞ্চয় করতে পারতেন। মানুষের ওপর, জনতার প্রতি তার ভালোবাসা ও নৈকট্যই তার ক্রমবিবর্তনের প্রগতিমুখীনতাকে স্বাভাবিক ও সম্ভব করে তুলেছিল।
বঙ্গবন্ধু শুরুতে ছিলেন এক দুরন্ত কিশোর 'মুজিবর'। অনেকের কাছে মুজিব ভাই। তার পর মুজিবর রহমান অথবা শেখ মুজিবুর রহমান। তার পর বহুদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে তার নাম ছিল 'শেখ সাহেব'। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন পরিচয় 'বঙ্গবন্ধু'। একাত্তরের পর তিনিই হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীন দেশের স্থপতি এবং 'জাতির পিতা'। তিন দশক সময়কালের মধ্যে এভাবেই ঘটেছিল তার অবস্থানের উত্তরণ।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শুরুটি ছিল 'পাকিস্তান আন্দোলনের' লড়াকু ছাত্র-কর্মী হিসেবে। তবে তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের উদারনৈতিক ও কিছুটা গণমুখীন প্রবণতাসম্পন্ন আবুল হাশেম-সোহরাওয়ার্দীর 'গ্রুপের' অনুগামী। ছিলেন ঢাকার নবাবদের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের বিরোধিতাকারী। বঙ্গবন্ধু একই সঙ্গে ছিলেন নেতাজি সুভাষ বোসের বিশেষ ভক্ত। তিনি ছিলেন গণসম্পৃক্ত ধারার লোক। সে কারণে তার মাঝে অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিকতা বোধের প্রাথমিক উপলব্ধি জন্ম নিয়েছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি জাতির ওপর পরিচালিত শোষণ-বঞ্চনা, বাংলা ভাষার ওপর আঘাত, মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের দ্বারা দলের নেতৃত্ব করায়ত্ত হওয়া ইত্যাদি ঘটনা বঙ্গবন্ধুকে অতি দ্রুতই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্ত করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের দাবি নিয়ে সংগ্রাম করে তিনি জেলে গিয়েছিলেন। তিনি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের একজন প্রধান সংগঠক হয়ে উঠেছিলেন। তার রাজনৈতিক জীবনে শুরু হয়েছিল এক নতুন আধ্যায়।



'৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু দু'দফায় প্রাদেশিক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে সময় আওয়ামী লীগের মূল নেতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ছিলেন বঙ্গবন্ধুর 'নেতা'। তাকে 'নেতার' ভুল পদক্ষেপগুলোকেও অনুসরণ করতে হয়েছিল। '৬২-এ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের রক্ষণশীল ও চিহ্নিত দক্ষিণপন্থি সিনিয়র নেতাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বঙ্গবন্ধু দলকে উদ্ধার করেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারায় দলে নিজের নেতৃত্ব সংহত করতে সক্ষম হন। এই পর্যায়ে তিনি দলের অবিসংবাদিত শীর্ষ নেতা বা 'সুপ্রিমো' হয়ে ওঠেন।
চলমান গণসংগ্রামের সবরকম স্রোতধারাকে ধারণ করে চলার কৌশল গ্রহণের ফলে ইতিহাসের ঠিক নির্ধারণমূলক সময়টিতে তিনি আওয়ামী লীগেরই শুধু নয়, বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামের নেতার আসনে নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি এবং তার নাম পরিণত হয় বাঙালি জাতির ঐক্যের ও সংগ্রামের প্রতীকে।

'৬১ সালের শেষ দিকে আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ, খোকা রায় প্রমুখের সঙ্গে কয়েকটি গোপন বৈঠকে তিনি মিলিত হন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সূচনা করার কৌশল নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। 'শেখ সাহেব' একাধিকবার পার্টির নেতাদের বলেন যে, গণতন্ত্র, বন্দিমুক্তি প্রভৃতি দাবির সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবিও তখনই ওঠানো উচিত। এর জবাবে কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা তাকে বলেন যে, 'স্বাধীনতার দাবিটি সঠিক বটে, তবে তা উত্থাপনের জন্য এখনও অবস্থা পরিপকস্ফ হয়নি। এখন গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে ছাত্রদের মধ্য থেকে আন্দোলন শুরু করতে হবে।' 'শেখ সাহেব' তার নেতা সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গেও কথা বলেন। শেষ বৈঠকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের বলেন, 'দাদা। আপনাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম, কিন্তু যুক্তিগুলো সব মানলাম না'।
'৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর 'শেখ সাহেব' বুঝতে পারেন, এখন স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে বাঙালির স্বাধিকারের জন্য জোরেশোরে নামার সময় এসে গেছে। তিনি ৬ দফা দাবি পেশ করে আন্দোলনে নেমে পড়েন। আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের আক্রমণকে উপেক্ষা করে তিনি এই দাবি নিয়ে সাহসী মহাবীরের মতো এগিয়ে যেতে থাকেন। সরকার মরিয়া হয়ে তার বিরুদ্ধে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' দিয়ে তাকে সবদিক থেকে 'শেষ করে দেওয়ার' চেষ্টায় নামে। পাকিস্তানি সরকারের প্রতিটি আঘাত সে সময় তার জন্য বীরমাল্যস্বরূপ ভূষণ হয়ে ওঠে। ক্রমান্বয়ে তার জনপ্রিয়তা অসামান্য উঁচু স্তরে পৌঁছে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির একক ও অবিসংবাদিত নেতা। ৬ দফাকে প্রগতিশীল কর্মসূচিতে সমৃদ্ধ করে রচিত হয় ঐতিহাসিক ১১ দফা। সংগঠিত হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। 'শেখ মুজিব' জেল থেকে মুক্ত হয়ে আসেন। তিনি ১১ দফার প্রতি সমর্থন ঘোষনা করেন। 'শেখ মুজিব' হয়ে ওঠেন 'বঙ্গবন্ধু'।
'৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু তার দলকে নিয়ে অভূতপূর্ব বিজয় ছিনিয়ে আনেন। ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক বাতিল করে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার নস্যাৎ করার পথ গ্রহণ করে। প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সমগ্র বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধু জনতার ক্রোধ ও স্বাধিকারের প্রত্যয়কে ধারণ করে জাতিকে স্বাধীনতার সংগ্রামের পথে এগিয়ে নেন। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। 'তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো...' ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে জেগে ওঠা জাতির ঐক্যের প্রতীক। স্বাধীনতার স্থপতি। জাতির জনক।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হয়। কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে পদার্পণ করেন। নতুন রাষ্ট্রের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় সাংবিধানিক রূপ প্রদানের কাজটি তার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। রচিত হয় '৭২-এর সংবিধান, ঘোষিত হয় ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি। সৃষ্টি হয় নতুন ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার হলো '৭২-এর সংবিধানের মূল আদর্শিক ভিত্তি। বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে একথা তাই সকলেরই উপলব্ধি করা বিশেষভাবে প্রয়োজন যে মুক্তিযুদ্ধ যেমন ছিল জনগণের 'নির্মাণ' তেমনি তা ছিল বঙ্গবন্ধুর 'কীর্তি'। মুক্তিযুদ্ধের এই ভিত্তির ক্ষেত্রে আপস, বিকৃতি, পদস্খলন বা বিপথগামী হওয়ার অর্থ হচ্ছে- বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক অবদানকে অস্বীকার করা ও তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা। অথচ তার দল আজ সেটিই করে চলেছে।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়কালটি হলো আরেকটি পর্ব। সেটি হলো দেশ পরিচালনার পর্ব। সে পর্বে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা একটি স্বতন্ত্র মূল্যায়নের বিষয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে ভালো-মন্দ অনেক কথাই থাকতে পারে ও আছে। কিন্তু বিজয়ী মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে যে 'ইতিহাস' আগেই রচিত হয়ে গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সেই 'ইতিহাস রচনার' মহানায়ক ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বহু স্মৃতি আমার রয়েছে। কোনো সময়ই আমি তার দল করিনি বা করতাম না। নীতি-আদর্শের ক্ষেত্রেও আমি ছিলাম ভিন্ন ধারায় বিশ্বাসী। কিন্তু তার সঙ্গে আমার ছিল বিশেষ আন্তরিক একটি সম্পর্ক। আগাগোড়াই তিনি আমাকে 'তুমি' বলে সম্বোধন করতেন। আমিও তাকে সামনাসামনি 'মুজিব ভাই' বলতাম। ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের হরতালে গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যাওয়ার পর তাকে আমি প্রথম সামনাসামনি দেখেছিলাম।। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, বিশেষত আমি ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর, মাঝেমধ্যেই বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাসায় এবং বেশিরভাগ সময়ে সরকারি কার্যালয় গণভবনে তার সঙ্গে আমার দেখা হতো। নানা বিষয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা হতো।
একদিন গণভবনে দুপুর হয়ে যাওয়ায় তিনি বললেন-'সেলিম, আজ তুমি আমার সাথে খেয়ে যাবে'। দোতলায় গিয়ে একসঙ্গে খেতে বসার পর আমাদের দু'জনকেই টিফিন ক্যারিয়ার থেকে তরকারি বেড়ে দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধু বললেন, 'তোমার ভাবির রান্না করা তরকারি ছাড়া আমার খাওয়া হয় না। সেখান থেকে এসেছে। ভালো করে খাও।' আমি বলেছিলাম, 'কষ্ট করে ৩২ নম্বর থেকে খাওয়া না এনে ভাবিকে কেন এখানে নিয়ে আসেন না?' জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'সেলিম, শোন। চিরদিন প্রধানমন্ত্রী থাকব, এমন তো নয়। এখানে সব ঘর এয়ারকন্ডিশন করা। একবার সেটাতে অভ্যাস হয়ে গেলে ৩২ নম্বরে গিয়ে এয়ারকন্ডিশন ছাড়া থাকতে কষ্ট হবে। তাই এখানে আনি না।' এ ধরনের নানা ঘটনা স্মৃতিতে জড়িয়ে আছে। সেসব কথা আজ থাক।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি