- চতুরঙ্গ
- ওড়াকান্দির ঠাকুরবাড়ি ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী হাওয়া
ওড়াকান্দির ঠাকুরবাড়ি ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী হাওয়া

গত ২৭ মার্চ থেকে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মাসব্যাপী আট দফায় ভোট গ্রহণের পর আগামী ২ মে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হবে। ভিনদেশি একটি প্রদেশের এই নির্বাচনে আমাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। তবে এক সময় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলে একটি প্রদেশ ছিল, ভারত বিভক্তির পর এপার-ওপার দেশান্তরিত হয়েছেন উভয় বঙ্গের প্রায় দুই কোটি মানুষ। ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, সামাজিক ও লোকাচার এক ও অভিন্ন হওয়ার কারণে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ উৎসুক থাকবেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার নেই। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে এ বছর সেই উৎসুক্যের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আয়োজিত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যোগদান উপলক্ষে গত ২৬, ২৭ মার্চ দু'দিনব্যাপী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করেন। নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মৌলবাদীদের নাশকতামূলক ও উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে প্রভাব ফেলার সুযোগ নেই। তবে তার এই সফরের আরেকটি দিক ওই নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিভিন্ন মহলে আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে। বিষয়টি হচ্ছে- সফরের সময় হিন্দুত্ববাদী নেতা নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশের দুটি মন্দির পরিদর্শন। সফরের দ্বিতীয় দিন ২৭ মার্চ তিনি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুটি মন্দির দর্শন এবং সেখানে পূজা, প্রার্থনা ও বক্তৃতা করেন।
হিন্দু পুরাণমতে ৫১ শক্তিপীঠের একটি বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর গ্রামের কালী মন্দিরে তার গমন করার বিষয়টি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গণ্য করা যেতে পারে। তবে একই দিন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দির হরিচাঁদ ঠাকুর মন্দিরে গমন করা নিছক ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অবকাশ নেই। বিশেষ করে ২৭ মার্চ ওড়াকান্দিতে এবং তারপর দেশে ফিরে বিধানসভা নির্বাচনী প্রচারে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় নরেন্দ্র মোদির দেওয়া বক্তৃতা বিশ্নেষণ করলে বিষয়টি অনেকটা পরিস্কার হয়ে যায়। এসব বক্তৃতায় মোদি মতুয়াদের প্রধান তীর্থস্থান ওড়াকান্দি ভ্রমণের কাহিনিসহ তিনি মতুয়াবাদের ভক্ত বলে প্রচার করেন।
কী এই মতুয়াবাদ এবং নরেন্দ্র মোদি কেনইবা তাদের প্রধান তীর্থস্থান ওড়াকান্দি ভ্রমণ করেছেন, সেসবের কিছুটা ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার ওড়াকান্দি নিবাসী হরিচাঁদ ঠাকুর প্রেমভক্তিরূপ সাধনধারাকে বেগবান করার জন্য যে সহজ সাধনপদ্ধতি প্রবর্তন করেন, তাকে বলা হয় 'মতুয়াবাদ'। এই মতবাদের অনুসারীরা 'মতুয়া' নামে পরিচিত। এরা মূলত তপশিলি হিন্দুদের মধ্যে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত একটি লোকসম্প্রদায়। তবে, নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায় ও ধর্মের কিছু মানুষ মতুয়াবাদে বিশ্বাস করেন। প্রায় ২১০ বছর আগে এক নমঃশূদ্র পরিবারে মতুয়াবাদের প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্ম হয়। মতুয়ারা তাকে দেবতা বলে মান্য করেন। পরবর্তীতে তার পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারসহ মতুয়া মতবাদ বিস্তৃতি লাভ করে। তাদের উভয়ের কর্মক্ষেত্র ছিল গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি। এখানেই মতুয়াদের প্রধান মন্দির ও তীর্থস্থান অবস্থিত।
রাজনৈতিক বিশ্নেষকদের মতে, গত ২৭ মার্চ শুরু হওয়া পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে মতুয়া ভোটারদের মন জয় করতেই ওড়াকান্দি ভ্রমণের গুরুত্ব দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। কারণ পশ্চিমবঙ্গের এবারের নির্বাচনে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর মতুয়া সম্প্রদায়ের তৎকালীন নেতা ব্যারিস্টার পি আর ঠাকুর তার শিষ্যদের বড় একটা অংশ নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যান এবং তার স্ত্রী বীণাপাণি দেবীর সহায়তায় বাস্তুচ্যুত মতুয়াদের জন্য উত্তর চব্বিশ পরগনার ঠাকুরনগরে প্রথম বেসরকারি উদ্বাস্তু কলোনি প্রতিষ্ঠাসহ ধর্মীয় কেন্দ্র গড়ে তোলেন। পি আর ঠাকুর আগে থেকেই কংগ্রেস দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
সে কারণে দেশান্তরিত হওয়ার পর একাদিক্রমে ১৯৫২, ৫৭ ও ৬২ সালে তিনি কংগ্রেসের টিকিটে পশ্চিমবঙ্গের একজন বিধায়ক নির্বাচিত হন এবং বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রিসভায় ডেপুটি মিনিস্টার হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৯০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার দুই ছেলে কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর এবং মনজুল কৃষ্ণ ঠাকুর প্রথমে কংগ্রেস এবং পরবর্তীতে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। বড় ভাই কপিল কৃষ্ণ ২০১৪ সালে বনগাঁ আসন থেকে তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে ভারতীয় লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। আর ছোট ভাই মনজুল কৃষ্ণ একই দলের প্রার্থী হিসেবে ২০১১ সালে গাইঘাটা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার মন্ত্রী হন।
২০১৪ সালের শেষভাগে কপিল কৃষ্ণ মৃত্যুবরণ করলে ২০১৫ সালে বনগাঁ উপনির্বাচনে তার স্ত্রী ও মতুয়া মহাসংঘ প্রধান মমতা বালা ঠাকুর তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। এই উপনির্বাচনে মঞ্জুল কৃষ্ণের বড় ছেলে সুব্রত ঠাকুর বিজেপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে মনজুল কৃষ্ণের ছোট ছেলে শান্তনু ঠাকুর প্রতিপক্ষ তৃণমূল প্রার্থী মমতা বালা ঠাকুরকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মমতা বালা ঠাকুর বর্তমানে তৃণমূল সরকারের মতুয়া উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান ও দ্বিখণ্ডিত মতুয়া মহাসংঘের একাংশের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পশ্চিমবঙ্গে মতুয়া মহাসংঘের অপর অংশের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মনজুল কৃষ্ণ ঠাকুর। এভাবে পশ্চিমবঙ্গের ঠাকুরনগরভিত্তিক প্রভাবশালী ঠাকুর পরিবার যখন রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত, তখনই পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া তথা তপশিলি ভোটারদের সমর্থন আদায়ের জন্য তাদের প্রধান তীর্থভূমি বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের নিভৃত পল্লি ওড়াকান্দি সফরের সুযোগ এসে যায় নরেন্দ্র মোদি হাতে। মোদি এ সুযোগেরই মোক্ষম ব্যবহার করেছেন, তা বলতেই হবে।
পশ্চিমবঙ্গের এবারের ভোটযুদ্ধে যে কেউ মতুয়াদের মন জয়ের সুযোগ পেলে তার যুতসই ব্যবহার করবেন, তা নিশ্চিত। কারণ ভারতের রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা বলছেন, মতুয়া সম্প্রদায় এবং তাদের ধর্মগুরুরা ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকেই সেখানে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে একটা সময় এই মতুয়াদের অধিকাংশ ভোট বামফ্রন্ট বা তৃণমূল কংগ্রেসে গেলেও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মতুয়া মহাসংঘ বিভক্ত হয়ে যায় এবং ভোটের হিসাবেও পরিবর্তন আসে। যার ফলে মতুয়া অধ্যুষিত দুটি লোকসভা আসন বিজেপির হাতে চলে যায়। তাই এবারের বিধানসভা নির্বাচনে এতটাই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে যে, মতুয়া ভোট অনেক আসনেই নির্ণায়ক হয়ে উঠবে।
মন্তব্য করুন