
করোনা (কভিড-১৯) মহামারি ১৫ এপ্রিল, ২০২১ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ২৯ লাখ ৮৫ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। এ সংক্রমণে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ কোটি ৮৮ লাখ ২০ হাজার। সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। ইউরোপ-আমেরিকাসহ সমগ্র বিশ্বই করোনা সংক্রমণ রোধে হিমশিম খাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ছয় লাখ; আক্রান্ত প্রায় ৩ কোটি ২২ লাখ। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে করোনা ভাইরাসকে চায়না ভাইরাস বলেছেন, সেই চীনে একই সময়ে মৃত্যু ৪৬৩৬ এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৯০ হাজার ৪৪৭ জন।
চীনে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি এখন পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। চীন সরকারের এ সাফল্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে উৎকর্ষ এবং উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থার অধিকারী পশ্চিমা দেশের সরকার এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বিস্মিত করেছে। করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে চীনের এই বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন কীভাবে সম্ভব হলো?
কভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব ও চীনের দ্রুত পদক্ষেপ : ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে প্রথম কয়েকজন নিউমোনিয়া সংক্রমণের উপসর্গ নিয়ে আক্রান্ত হয়। ২৭ ডিসেম্বর হুবে প্রাদেশিক হাসপাতাল প্রথম উহান মিউনিসিপ্যাল স্বাস্থ্য কমিশনকে জানায় তাদের হাসপাতালে অজ্ঞাত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংবাদ। উহান মিউনিসিপ্যাল স্বাস্থ্য কমিশন সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি তদন্ত এবং রোগীদের পরীক্ষা করার জন্য এটিমোলজিস্ট নিয়োগ করে। ৩০ ডিসেম্বর উহান স্বাস্থ্য কমিশন সব স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এবং জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনকে এই অজ্ঞাত নিউমোনিয়ার সংবাদ জানায়। জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন এ বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করে। ৩১ ডিসেম্বর থেকেই মাঠে তদন্ত এবং মহামারি মোকাবিলা সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ পাঠায়। উহান মিউনিসিপ্যাল স্বাস্থ্য কমিশন ওয়েবসাইটে এই অজ্ঞাত নিউমোনিয়ায় ২৭ জন আক্রান্তের সংবাদ পরিবেশন করে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চীনস্থ অফিসকে এই অজ্ঞাত ভাইরাস সম্পর্কে অবহিত করে। একই সঙ্গে জনগণকে মাস্ক পরা, ঘেরাও দেওয়া স্থান ও জনসমাবেশে না যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত আরও ৪৪ জন আক্রান্ত হয়। এ সময়ের মধ্যেই ব্যাপক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ৭ জানুয়ারি চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এই অজ্ঞাত ভাইরাসকে কভিড-১৯ বলে অভিহিত করে। ক্রমশ এর সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং কয়েকটি প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে আরও কয়েকটি প্রদেশে এ সংক্রমণ দেখা দেয় এবং রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। আন্তর্জাতিক যাতায়াতের মাধ্যমে এ ভাইরাস ধীরে ধীরে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু রাষ্ট্র, যারা প্রথমদিকে বিষয়টিতে তেমন গুরুত্ব দেয়নি, তারাই এখন সমস্যায়। কিন্তু চীন প্রথম থেকেই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় এবং যুদ্ধকালীন অবস্থার মতো বিবেচনা করে। সংক্রমিত ব্যক্তিদের শনাক্ত এবং সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলা সংক্রমণের উৎস অনুসন্ধানে এপিডেমিওলজিস্টদের নিয়ে ১৮শ টিম গঠন করা হয়। এসব টিম প্রতিদিন হাজার হাজার লোকের ওপর জরিপ চালায়।
কভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত কিংবা সংক্রমণের জীবাণু বহনকারী ব্যক্তিদের শনাক্তকরণে এয়ারপোর্ট, রেলস্টেশন, দূরপাল্লার বাস স্টেশন, ফেরি টারমিনালে ইন্ফ্রা-রেড থার্মোমিটার ব্যবহার করে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা; বিভিন্ন স্টেশনে হাজার হাজার কোরেন্টাইন কেন্দ্র স্থাপন; পরবর্তী সময়ে করোনা শনাক্তকরণে মানুষকে কর্মস্থল, দোকানপাট এবং সড়কে এই স্ট্ক্রিনিং পদ্ধতি চালু করা হয়। এ ছাড়াও সার্স মহামারি মোকাবিলায় বিভিন্ন সড়কে স্থাপিত ক্যামেরার আধুনিকায়ন করা হয়। এসব ক্যামেরা সড়কে মাস্ক ছাড়া ব্যক্তিকে শনাক্ত এবং জরিমানা করতে সাহায্য করে।
লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব :ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় চীনের অভিজ্ঞতা অনেক দিনের। ২০০৩ সালে সার্স সংক্রমণ মোকাবিলা করে চীন অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ২২ জানুয়ারি ৫৭১ হলে সরকার পরদিন থেকে উহান এবং হুবে প্রদেশের অন্যান্য শহরে লকডাউন (ঢিলেঢালা নয়) ঘোষণা করে। উহান শহরকে চীনের সব শহর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। আন্তর্জাতিক চলাচল বন্ধ, সরকারি জনসমাগম বন্ধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়িয়ে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির মধ্যে সংক্রমণ বিস্তার বন্ধ করা। পাবলিক সুবিধাগুলো জীবাণুমুক্ত রাখতে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
মহামারির প্রস্তুতি গ্রহণ :করোনায় আক্রান্তদের শনাক্ত করে তাদের দ্রুত সুচিকিৎসায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়। সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির দ্রুত হার দেখে সরকার আশঙ্কা করে, বিদ্যমান হাসপাতালগুলোয় রোগীদের স্থানের সংকুলান হবে না। তাই সরকার গত বছর জানুয়ারি মাসেই মার্স মহামারি মোকাবিলায় নির্মিত শিয়াটাংশান হাসপাতালকে করোনা রোগীদের জন্য প্রস্তুত এবং নতুন হাসপাতাল নির্মাণ শুরু করে। মাত্র ১০ দিনের মধ্যে সব রকম আধুনিক চিকিৎসা সুবিধাসহ ১০০০ শয্যাবিশিষ্ট আরেকটি হাসপাতাল নির্মাণ সম্পন্ন করা হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বহু হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং কোরেন্টাইন সুবিধা নির্মাণ করা হয়। সমগ্র চীন দেশেই বৃদ্ধ এবং সংকটজনক রোগীদের জন্য পৃথক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। ৪০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীকে এসব কাজে নিয়োজিত করা হয়। চীনের সব জায়গা থেকে তাদেরকে সংগ্রহ করা হয়। কভিড-১৯ এর সময় হাসপাতালের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সর্বক্ষেত্রে বিশেষ যত্ন ও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ইতোপূর্বে সার্স ও মার্স মহামারির সময় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল।
চীনে কভিড-১৯ এখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। জনজীবন স্বাভাবিক। এটা সম্ভব হয়েছে একদিকে চীনের সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, জনবান্ধব পরিকল্পনা ও সমন্বয়, দৃঢ় পদক্ষেপ, সব কর্তৃপক্ষ, কমকর্তা-কর্মচারীদের ঐকান্তিক পরিশ্রম; অন্যদিকে জনগণের পূর্ণ সহযোগিতায়। জনগণ সরকারকে সহযোগিতা করেছে সব নির্দেশনা মেনে চলে, মাস্ক পরিধান করে, সামাজিক দূরত্ব মেনে ও কভিড-১৯ প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করে। প্রায় ১৮ কোটি মানুষ এ পর্যন্ত করোনা টিকা গ্রহণ করেছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরাও এ সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
মন্তব্য করুন