
করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই-সংগ্রাম করতে করতে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের কথা যেন অনেকটা ভুলতেই বসেছি। টিকা আসার পরও সেটা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে যাওয়া, টিকার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন, বিভিন্ন প্রজাতির ভাইরাসের আবির্ভাবসহ নানা কারণে করোনাভাইরাসের সঙ্গে এখনও আমাদের কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর মাঝে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি ভুলে যাওয়া কোনোভাবেই উচিত হবে না। এ বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে প্যারিস চুক্তিতে ফিরে এসে আবারও গুরুত্ব দিয়ে যেন সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূতের ঢাকা সফর জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি পৃথিবীর জন্য বড় আরেকটি ইস্যু, তা নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।
জলবায়ুর অতি সামান্য যে পরিবর্তন ইতোমধ্যে লক্ষ্য করা গেছে, এর প্রাথমিক ক্ষতিকর প্রভাব পৃথিবীর মানুষকে চমকে দিয়েছে। আমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই জাতিসংঘের বিজ্ঞানীদের গত দু'বছর আগে রেড-অ্যালার্ট জারির কথা। কারণটা অন্য কিছু নয়, মানুষের নানামুখী কর্মকাণ্ড। যে কারণে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি পরিমাণে বরফের আচ্ছাদন বিলীন হচ্ছে, কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। জীবজন্তুর বিভিন্ন প্রজাতি আবাসস্থল বদল করছে। ফলে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, যা আমরা সাধারণভাবে টের পাচ্ছি না।
বিজ্ঞানীদের সমীক্ষায় উঠে এসেছে, করোনা মহামারি এই সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা কতটুকু সচেতন? তরুণ প্রজন্ম কতটুকু জানে? সবারই কি কিছু করণীয় আছে? বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আদৌ কি আমরা কোনো পরিকল্পনা করতে পেরেছি? বিশ্বনেতারা কি গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ আদৌ শূন্যে নামিয়ে আনতে পারবেন?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা প্রতিনিয়ত আবহাওয়ার আচরণ পাল্টাতে দেখছি। ঘন ঘন নিম্নচাপ হচ্ছে, আমরা মুখোমুখি হচ্ছি ঘূর্ণিঝড়ের, অতিবৃষ্টি আর বন্যার। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্বাভাবিক কাজ-কর্ম, জনজীবন, অর্থনীতি কমবেশি সবকিছুই। গত নভেম্বর, ২০২০ থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের একটি বিশেষ অবস্থা বা লা নিনা সক্রিয় হয়ে ওঠার কারণে সাগর থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু এবং মেঘ বাংলাদেশের দিকে বেশি আসছে। ফলে দেশে এবার বৃষ্টি বেশি হওয়া ও আগাম বন্যার সম্ভাবনা রয়েছে- এই অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
লা নিনার প্রভাবে এবার শীতেও আমরা ঠিকভাবে শীতের চরিত্র বুঝতে পারিনি। সাগর থেকে গরম বাতাস এসে আকাশ মেঘলা করে দিয়ে শীত কমিয়ে দিয়েছে। আবহাওয়াবিদরা অনুমান করছেন, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে কালবৈশাখী ও বজ্রপাত আরও বাড়বে। এ ক্ষেত্রেও লা লিনার প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এমন নানামুখী পরিবর্তন ঘটছে। এককথায় ভূপৃষ্ঠের গড় উষ্ণতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এক সংকটজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে মানুষ। বাংলাদেশে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কিছু দিক। ভৌগোলিক অবস্থানগত অসুবিধা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও নীতিমালা বাস্তবায়নে ঘাটতি, দুর্নীতি ও দুর্বলতা ইত্যাদি আমাদের বৈরী পরিস্থিতির জন্য। ফলে বাংলাদেশে এ-সংক্রান্ত সার্বিক বিপন্নতা ধীরে হলেও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি।
গত মাসে গ্লোবাল ইয়ুথ ক্লাইমেট সামিটে 'যুব ও জলবায়ু পরিবর্তন :বাংলাদেশ প্রসঙ্গ' শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়েছিল। জরিপটি পরিচালনা করেছিল বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) ও সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ (সিইউএস)। জরিপে দেশের প্রত্যেক বিভাগের ১৮-৩৫ বছর বয়সী ২ হাজার তরুণ-তরুণী অংশগ্রহণ করেছিল। জরিপের অন্যান্য ফলাফলের পাশাপাশি জ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে যে ফলটি তুলে ধরা হয় তাতে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি শুনেছে ৯৭ শতাংশ তরুণ-তরুণী। তাদের মধ্যে ৫৩.৮৫ শতাংশ এ সম্পর্কে ভালোভাবে বলতে পারে। ২৬.৮২ শতাংশ তরুণ-তরুণী এ সম্পৃক্ত সরকারি উদ্যোগ ও আইন সম্পর্কে জানে এবং ৪৮.৮৪ শতাংশ তরুণ-তরুণী এ বিষয়ে বিভিন্নমুখী উদ্যোগ গ্রহণে আগ্রহী ও তারা সহযোগিতা এবং পরামর্শ চায়। অন্যদিকে 'রাইজিং টু দি চ্যালেঞ্জ :ইয়ুথ পারসপেকটিভস অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এডুকেশন ইন বাংলাদেশ' শিরোনামে ইউনিসেফের (ফেব্রুয়ারি ২০২১) আরেকটি গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়। ওই গবেষণায় তরুণদের জলবায়ু সম্পর্কে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অনুসন্ধান করা হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশে পরিচালিত এই গবেষণায় বাংলাদেশের ১৫-২৪ বছর বয়সী ৫ হাজার ৫৮৬ জন তরুণ-তরুণী অংশগ্রহণ করে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে বলতে বা ব্যাখ্যা করতে পারবে এমন তরুণ-তরুণীর সংখ্যা ৫০ শতাংশ। ৭৭ শতাংশ তরুণ-তরুণী প্রায়ই বা মাঝেমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে বিদ্যালয় থেকে জানতে পারে। ৫৪ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে আরও জানতে কিংবা শিখতে চায়। ৫ শতাংশ তরুণ-তরুণীর জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে কোনো ধরনের শেখার আগ্রহ নেই। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত নির্ভরযোগ্য এসব গবেষণা থেকে কয়েকটা বিষয় সুস্পষ্ট : এক. তরুণ-তরুণীদের মাঝে এ নিয়ে জানার আগ্রহ ও ঘাটতি আছে; দুই. এ বিষয়ে নিজেদের করণীয় জানা না থাকার কারণে সরকারের দিকে মুখাপেক্ষী অনেকেই এবং সরকারি উদ্যোগ সম্পর্কেও বেশিরভাগ তরুণ-তরুণীই কিছু জানে না। এ ছাড়া সংখ্যায় অল্প হলেও একদল তরুণ-তরুণী জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে কিছুই জানে না, কিংবা তাদের এ সম্পর্কিত কোনো কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বর্তমান সময়ে মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাসের ফলে পৃথিবীর উষ্ণায়নকে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। যেটি কার্বন-ডাই অপাইডের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ধরা হয়।
অতি সম্প্রতি ক্ষতিকর মিথেন গ্যাস উৎপাদনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা পালনের বিষয়টি যুক্ত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা গেল্গাবাল ওয়ার্মিংয়ের ক্ষেত্রে গ্রিনহাউস গ্যাস, কার্বন-ডাই অপাইডের থেকেও মারাত্মক মিথেন। অথচ বাংলাদেশ এই গ্যাস উৎপাদনে শীর্ষে অবস্থান করছে। প্যারিসভিত্তিক একটি তথ্য বিশ্লেষক সংস্থা স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্নেষণ করে এই তথ্যটি (এপ্রিল ২০২১) প্রকাশ করেছে। এসব নানা কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে- পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি সবকিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে। শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোই সর্বোচ্চ ক্ষতিকর গ্যাস উৎপাদক দেশ, আর বাংলাদেশ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের সর্বোচ্চ ক্ষতি ভোগের দেশ।
প্যারিস চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র আবার ফিরে এসেছে এবং এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার জন্য নতুন প্রেসিডেন্ট বিশেষভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। শুধু তাই নয়, তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে ধরিত্রী দিবস উপলক্ষে এপ্রিল মাসের ২২ ও ২৩ তারিখে ভার্চুয়াল মাধ্যমে একটি শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলনও আহ্বান করেছেন। ধরিত্রী দিবস উপলক্ষে গুরুত্বপূর্ণ আসন্ন এই সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ তাই বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গুরুত্বপূর্ণ হবে সম্মেলনে অংশ নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে তরুণ সমাজকে যুক্ত করার বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে উত্থাপন করা। কারণ ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের জনসংখ্যা পর্যালোচনা করে দেখা যায় সব দেশেই এখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশেও মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। এ তরুণরাই অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ইতিহাস সৃষ্টি থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনন্য অবদান রেখে আসছে। তাদের ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করার দিকটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সম্মেলনে আলোচিত হবে- সেটাই প্রত্যাশা করব। আপদকে ভয় না পেয়ে দৃঢ়ভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, আর সে জন্য তরুণ সমাজকে যুক্ত করে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করাটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
মন্তব্য করুন