- চতুরঙ্গ
- তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ

ফাইল ছবি
তখন সম্ভবত ক্লাস সিক্সে পড়ি। বয়স আর কতই বা হবে! সে বয়সে প্রথম জানলাম হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের এক ধরনের মানুষ আছে। আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন তাদের দু'জন, কারণ আমাদের বাড়িতে নতুন শিশুর জন্ম হয়েছিল; আমার চাচাতো ভাই। হিজড়ারা এসে অনেক নাচ-গান করল, ছোট ভাইটিকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করল বকশিশ নেওয়ার জন্য। পরবর্তী সময়ে আরও কিছু ঘটনায় বুঝতে পারলাম এই মানুষগুলো কিছুটা আলাদা। তবে বুঝতে পারলাম না কোথায় তারা আলাদা! মনের মধ্যে একটা সংশয় রয়েই গেলো। যদিও তারপরেও আমাদের বাড়িতে ঝটিকা সফরে আসতে দেখেছি এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের।
অনেকদিন পর আবার এই মানুষদের ব্যাপারে খবর দেখেছিলাম যখন শাহবাগের মঞ্চ নিয়ে দেশ খুব আলোড়িত। তখন খবর হয়েছিল এক হিজরা কীভাবে এক ব্লগারকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁচিয়েছিলেন। ইদানীং আবার খবর দেখলাম 'খবর পাঠিকা' হিসেবে কাজ করছেন তৃতীয় লিঙ্গের এক মানুষ। আবার দেখলাম তারা ঢাকা মেডিকেলের সামনে মমতার সঙ্গে করোনা রোগীদের সাহায্য করছেন হাসপাতালের ভেতরে নেওয়ার জন্য।
এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে আমাদের অনেকেরই ধারণা স্পষ্ট নয়। আমরা ভাবি তারা মনে হয় এক ভিন্ন প্রজাতির মানুষ, তাই তারা যাই করে তাতেই আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ি। আসলে আমাদের মতোই সাধারণ এক মানুষ তারাও। পার্থক্য শুধু ক্রোমোজমে। আমাদের মানুষের দেহের প্রতিটি কোষে (মানুষের দেহে প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন কোষ থাকে) ৪৬টি ক্রোমোজম থাকে। তারমধ্যে ১ জোড়া এক্স ওয়াই ক্রোমোজম থাকে পুরুষের ক্ষেত্রে, আর ১ জোড়া এক্সএক্স থাকে নারীর ক্ষেত্রে। কিন্তু, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের ক্ষেত্রে আর একটা বাড়তি এক্স অথবা ওয়াই অথবা শুধু একটা এক্স বা এক্স-এর সঙ্গে অপেক্ষাকৃত ছোট্ট একটা ওয়াই ক্রোমোজম থাকে; বা, আরও কিছু কম্বিনেশন হতে পারে। ফলে, তাদের প্রজননতন্ত্র এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেহের গঠন ভিন্ন ভিন্নভাবে গড়ে ওঠে। সাধারণত তারা প্রজননশীল হয় না। এই ধরনের গঠনের প্রাণী পৃথিবীতে প্রচুর আছে। সুতরাং, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়ার কিছু নেই।
প্রজনন ক্ষমতা না থাকলেই কেউ সমাজে অপাঙক্তেয় হয়ে যায় না। তারা সমাজের আর দশটা পুরুষ-নারীর মতো সাধারণ মানুষ। এক ধরনের মাছ আছে সমুদ্রে, যাদের দলের বড় মাছটি মেয়ে মাছ, তারপরের আকারে বড় মাছটি ছেলে মাছ। বাকি মাছগুলো ছেলেও না মেয়েও না। কিন্তু ওই দলের বড় মেয়ে মাছটি মারা গেলে ছেলে মাছটি মেয়ে মাছে পরিণত হয়। তাদের দলের তারপরের বড় আকৃতির মাছটি ছেলে মাছে পরিণত হয়ে দলের প্রজননের দায়িত্ব নেয়। বাকিরা প্রজনন ক্ষমতাহীন হয়েও সমান যোগ্যতা নিয়ে দলে থাকে। একইভাবে, মানুষের ক্ষেত্রেও সত্য যে, কিছু মানুষ প্রজননের দায়িত্ব ছাড়াই জন্ম নেয় পৃথিবীতে। সুতরাং, সমাজে তাদের আলাদাভাবে ভাবার কিছু নেই।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ মানবসমাজের অংশ। তারা সমাজের বোঝা নয়। আমরা তাদের চিনতে ভুল করেছি প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে। যাদের সুযোগ আছে তারা আপনাদের সন্তান ও প্রিয়জনের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলে তাদের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ সম্পর্কে সচেতন করতে পারেন। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, পুরুষ এবং নারীর মতো সমাজের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বশীল পদে আসীন হোক এই কামনা করি।
মন্তব্য করুন