বিচারের মাধ্যমে যে শাস্তি প্রদান করা হয় তার অন্যতম উদ্দেশ্য অপরাধীদের মধ্যে অনুশোচনার মনোবৃত্তি তৈরি হওয়া। যার অন্যতম লক্ষ্য অপরাধ প্রতিরোধ। সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে দেখে অন্যরা যাতে অপরাধ থেকে দূরে থাকে। কিন্তু সেই শাস্তি খুব কঠিন না হলে অনুশোচনা দূরের কথা বরং বারবার অপরাধ করার আগ্রহ তৈরি করে। এতে শাস্তির উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে বাধ্য। বিচারের মাধ্যমে আমরা যে শাস্তি প্রদান করি, সেই শাস্তির প্রক্রিয়া যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে অপরাধী অনেক সময় তার অপরাধকর্ম ও অপরাধ করলে যে শাস্তি পেতে হয়, তা ভুলে যেতে পারে, সংশোধন তো দূরের কথা। অনেকে আবার মনে করেন, শাস্তির লক্ষ্য অন্য আর সবাইকে অপরাধ সংঘটনে বাধা প্রদান। এ উদ্দেশ্যে অপরাধীকে এ জন্য শাস্তি প্রদান করা হয়, যাতে শাস্তিটি সবার কাছে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এবং শাস্তির ভয়ে অন্যান্য ব্যক্তি অপরাধমূলক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকে।

এ ক্ষেত্রে মনে করা হয়, সমাজ যদি অপরাধীকে বিচারালয়ের সম্মুখীন করতে এবং অপরাধের জন্য যথাযথ শাস্তি প্রদানে ব্যর্থ হয় তবে তার ফল হবে মারাত্মক। কেননা, এতে সমাজের আর সবাই অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হতে কোনো প্রকার ভয়-ভীতি বা বাধার সম্মুখীন হবে না। মূলত এ অবস্থায় অপরাধকে প্রকারান্তরে উৎসাহিতই করা হয়। ফলে অপরাধমূলক তৎপরতা সমাজে দ্রুতগতিতে বেড়ে যায়। সে কারণেই শাস্তি অনেক ক্ষেত্রে দ্রুত অন্য সবার ওপর এমন প্রভাব রাখবে, যাতে তারা অপরাধমূলক চিন্তা বা কর্ম থেকে বাধ্য হয়েই বিরত থাকবে। কোনো বিশেষ বা বড় শাস্তি যেমন মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অন্যদের মনে এমন ভীতির সঞ্চার করতে পারে, যা তাদের চরিত্র সংশোধনের জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখতে সক্ষম। শাস্তি আর সবার জন্য সর্তকবাণী যা দ্বারা এটা আশা করা হয় যে অন্যরা কুপ্রবৃত্তি ত্যাগ করবে এবং নিজেরাই সংশোধিত হবে।

কিন্তু সেই শাস্তি যদি অপরাধের বিপরীতে যথাযথ ও উপযুক্ত না হয় এবং শাস্তি প্রদান দীর্ঘায়িত হয় তাহলে অপরাধ প্রতিরোধ কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়ে। আমরা জানি, অপরাধ বিবেচনায় শাস্তি নির্ধারিত। কোন ধরনের অপরাধে কতটুকু সাজা হবে তা অপরাধ আইনে উল্লেখ থাকে। তবে শাস্তি দিতে হলে বড় যে কাজটি করতে হয় তা হলো অপরাধকে প্রমাণ করা। অপরাধ সংঘটিত হয়েছে- কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত প্রমাণ করা না যাচ্ছে, ততক্ষণ শাস্তি প্রদান করা যাচ্ছে না। এ কাজ বেশ কঠিন, সন্দেহ নেই এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের বিষয়। সঠিক ও উপযুক্ত সাক্ষী উপস্থাপন করা এবং তাদের সুরক্ষা বড় নিয়ামক। আবার এমন অপরাধ আছে যেখানে অপরাধের সময় আশপাশে কেউ না থাকায় সাক্ষী একদম পাওয়া যায় না। অপরাধ প্রমাণ অধরাই রয়ে যায়। এমন জটিল বিষয়ের জন্য অপরাধ ঘটলেও শাস্তির আওতায় না আসার জন্য অপরাধ পরিসংখ্যানে গরমিল দেখা দেয়। শাস্তি থেকে মুক্ত অপরাধীরা অনুশোচনা, সংশোধন থেকে শুধু দূরেই থাকে না; আবারও অপরাধ করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করে না। মোটাদাগে ব্যাহত হয় অপরাধী সংশোধন ও অপরাধ প্রতিরোধের কাজ।

পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থার কারণে আগেকার মতো নিজ আগ্রহে সাক্ষ্য দেওয়ার প্রবণতা অনেক কমে আসছে। এর বিশেষ কারণ সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখানো, মারধর, হুমকি এমনকি হত্যার মতো ঘটনাও ঘটে। অন্য প্রেক্ষাপট আদালতে দাখিলকৃত চার্জশিটে অপরাধ ঘটনার বিস্তারিত ও সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপনে সমস্যা ও সঠিক ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসেবে বিবেচনা না করা। ফলে অনেক গুরুতর অপরাধ হালকা বা লঘু হিসেবে বিবেচিত হতে দেখা যায়; আবার বিপরীত অবস্থাও তৈরি হতে পারে। যার ফল প্রকৃত অপরাধীর শাস্তির আওতায় না আসা। এ সমস্যা সমাধানে অনেক সময় সম্পূরক চার্জশিট প্রদানের আবেদন করা হয়। কিন্তু তা কতটুকু সুবিধা করতে পারে, বলা মুশকিল।

বড় বিষয়, দীর্ঘদিন বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হলেও যথাযথ সাক্ষীর অনুপস্থিতি, আদালতে সময় নেওয়াসহ অন্যান্য কারণে বিচারকার্য দীর্ঘায়িত হয়। এর ফলে অপরাধী তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এক প্রকার ভুলে যায়। সমাজ ও পরিবারে যখন সে স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন তার সম্পর্কে অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি আর অপরাধ বিষয়ক থাকে না। অন্যরা এমনও ভাবতে পারে, ব্যক্তি অপরাধ করেনি; তাকে অহেতুক হয়রানি করা হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শাস্তি সুরক্ষার বিষয়টি অপেক্ষাকৃত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনা হয়। সাক্ষী সুরক্ষা আইনও রয়েছে। যিনি সাক্ষ্য দেবেন, পরবর্তী সময়ে তার সমস্যা হলে রক্ষা করার দায়িত্ব কাউকে নিতে হবে। কেননা, মূল কাজ অপরাধ প্রমাণ ও যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা। কিন্তু একমাত্র সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে যদি হয়রানি ও মৃত্যুঝুঁকি থাকে তাহলে সাক্ষীরা বরং দূরেই থাকবে।

অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান প্রবর্তন করার মহত্ত্ব শুধু অপরাধী ব্যক্তিটির চারিত্রিক সংশোধনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে অপরাধ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না। আর সেটা যদি দীর্ঘ সময়ব্যাপী ঘটে এবং সবশেষে পর্যাপ্ত সাক্ষীর অভাবে শাস্তিই না দেওয়া যায় তাহলে বারবার অপরাধমূলক ঘটনা ঘটবে ও এর মাত্রা বেড়ে যাবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেমন বড় বিষয়, তার চেয়েও বড় বিষয় দ্রততম সময়ের মধ্যে শাস্তি প্রদান, যাতে অপরাধী যেমন বুঝতে পারে, সে অপরাধ করেছে; তেমনি ভিকটিমও অপরাধ গায়ে লেগে থাকা অবস্থায় বিচার পায়। নিরপরাধ মানুষরাও বুঝতে পারে, অপরাধের শাস্তি হয়েছে, যা তাদেরকে অপরাধমূলক আচরণ থেকে দূরে রাখতে সহায়ক হবে। এ জন্য আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। অপরাধ প্রমাণে সঠিক চার্জশিট প্রদান, উপযুক্ত সাক্ষী উপস্থাপন, সাক্ষী সুরক্ষা নিশ্চিত করা সর্বোপরি দ্রুত সময়ে বিচার কাজ সম্পন্ন করা দরকার। এতে বিচারে শাস্তি নিশ্চিত হবে; অপরাধীদের মধ্যে অনুশোচনা ও সংশোধনের বীজ রোপিত হবে; অন্যরা সংশোধিত হবে এবং যার ফলে অপরাধের মাত্রা ক্রমাগত কমতে থাকবে। পুলিশ, বিচারক এবং এর সঙ্গে যুক্ত অন্যদের নিরলস প্রচেষ্টা; সর্বোপরি অপরাধ প্রমাণে সাক্ষীদের এগিয়ে আসা ও তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে অপরাধ সংশোধন ও প্রতিরোধে।