- চতুরঙ্গ
- জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেটের প্রয়োজনীয়তা
জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেটের প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশে সর্বপ্রথম জেন্ডার বাজেট প্রস্তাবিত হয় ২০০৯-১০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে। প্রাথমিক পর্যায়ে চারটি মন্ত্রণালয়ের জন্য জেন্ডার বাজেট বরাদ্দ রাখা হলেও বর্তমানে সব মন্ত্রণালয়ের জন্যই আলাদাভাবে এ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। তবে এ বরাদ্দের সবচেয়ে বেশি অংশ ব্যয় করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রথম অর্থবছরে এ বরাদ্দের পরিমাণ মোট বাজেটের ২৪.৬৫ শতাংশ রাখা হলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর আকার পাঁচ গুণ বেড়ে হয় ৩০.৮২ শতাংশ। বরাদ্দ বাড়লেও এর যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেটি পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি।
২০০৯ সাল থেকে শুরু করে প্রতি বছর এ বাজেটের আকার বড় হলেও করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে আলাদাভাবে জেন্ডার বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়নি, যদিও স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নারীদের বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এ বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় দেশের দারিদ্র্যপ্রবণ ১০০টি উপজেলার সব বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের ভাতার আওতায় আনার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। তবে তাতে নারী সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি, কেননা করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারীরা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের একটি গবেষণায় দেখা যায়, করোনার কারণে দেশের অর্ধেকেরও বেশি নারী শ্রমিক (৫৪ শতাংশ) কাজ হারিয়েছেন। এ ছাড়া বাল্যবিয়ে বেড়েছে ৫৮ শতাংশ এবং ঘরোয়া সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৬৭ শতাংশ নারী। এর ফলে বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনে ২০২০ সালে ১৫৬টি দেশের মধ্যে ৫০তম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ ২০২১ সালে এসে ১৫ ধাপ পিছিয়ে ৬৫তম অবস্থানে আছে।
করোনা মহামারি সংকটের মধ্যেই শুরু হয়েছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট তৈরির কাজ। বিগত বছরের মতো এ বছরও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। আগামী অর্থবছরের সম্ভাব্য ৬ লাখ কোটি টাকার বাজেটে যে ৯টি বিষয় প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে নারী উন্নয়নের বিষয়টি আলাদাভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় দুস্থ ও অসহায় নারীদের জন্য ভাতা নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও সার্বিকভাবে নারী উন্নয়নে আলাদাভাবে জেন্ডার বাজেটের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা জেন্ডার বাজেটে যেহেতু নারীর ক্ষমতায়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি ও সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে সুযোগ বৃদ্ধি- এই তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তাই লিঙ্গবৈষম্য নির্ধারণের প্রধান প্রধান সূচকগুলোতেও এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
এ ছাড়া করোনার প্রভাবে দেশে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনাকালে স্বামী বা অন্তরঙ্গ সঙ্গী দ্বারা নারী নির্যাতনের তালিকায় বাংলাদেশ বিশ্বে ১৬তম অবস্থানে রয়েছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দেশে নারী নির্যাতনের হার বেড়েছে ২৪ শতাংশ। নারী নির্যাতনের পাশাপাশি বেড়েছে বাল্যবিয়ে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাল্যবিয়ের প্রবণতার দিক থেকে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।
করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের অবস্থা উন্নয়নেও জেন্ডার বাজেটের বিকল্প নেই। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির একটি গবেষণায় দেখা যায়, করোনার প্রভাবে ১৯ শতাংশ নারী পোশাক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন এবং ৪৯ শতাংশ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। বিগত অর্থবছরের বাজেটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এক হাজার কোটি টাকা সরকারি প্রণোদনা বরাদ্দ রাখা হলেও সিপিডির গবেষণায় দেখা যায়, ৯৩ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা এই প্রণোদনার জন্য আবেদন করেননি। কারণ হিসেবে দেখা যায়, ৫৮.৬ শতাংশ নারী উদ্যোক্তার সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে ধারণা নেই। অভিবাসী নারীরাও রয়েছেন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে ২০,৭৮৮ জন নারী অভিবাসী দেশে ফিরে এসেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই বিদেশ যাওয়ার উদ্দেশ্যে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছিলেন, যা এখনও চলমান। তাদের ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল পরিবারগুলোও নতুন করে দারিদ্র্যের কবলে পড়ছে।
গত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও করোনার কারণে বিভিন্ন রকম স্বাস্থ্যসেবা স্থগিত থাকায় পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু হার বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, মহামারির প্রভাবে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যু বেড়েছে ১৩ শতাংশ এবং মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগা ৮০ শতাংশ শিশু পুষ্টি কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে এখনও হাজারে চল্লিশেরও বেশি শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। পাশাপাশি বেড়েছে মাতৃমৃত্যু হার, গাইনি চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) তথ্য অনুযায়ী করোনা মহামারির আগে বাড়িতে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মাতৃমৃত্যুর হার ৩২ শতাংশ থাকলেও এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৪ শতাংশ হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১১ সালের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে ২০২১ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যু হার ১ দশমিক ৫ শতাংশে এবং শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১৫তে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
যে চারটি সূচকের ভিত্তিতে বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন তৈরি করা হয়, সেগুলো হচ্ছে নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ, শিক্ষায় অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্য ও আয়ু এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। যেহেতু বিগত বছরগুলোতে জেন্ডার বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই সূচকগুলোতে ভালো অবস্থানে ছিল, আসন্ন অর্থবছরের বাজেটেও এই বরাদ্দ অব্যাহত থাকলে দেশে লিঙ্গসমতা অর্জিত হতে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। কোনো সমস্যা সমাধানে বিশেষ মনোযোগ দিলে তা থেকে সুফল আসতে বাধ্য।
আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে যথা- ক. নারী নির্যাতন ও বাল্যবিয়ের হার কমানোর লক্ষ্যে জেন্ডার বাজেটের মাধ্যমে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কার্যক্রমের জন্য আলাদাভাবে বরাদ্দ রাখা; খ. দেশে ফিরে আসা অভিবাসী নারীদের এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নারী উদ্যোক্তাদের পুনর্বাসনে নারী উন্নয়নের জন্য ১০০ কোটি টাকার যে থোক বরাদ্দ রাখা হয়, সেটি বহাল রাখার পাশাপাশি এর সঠিক ব্যবহারে কিছু মূলনীতি নির্ধারণ করে দেওয়া; গ. সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী এবং স্বাস্থ্য খাতে পরিকল্পিত ও লক্ষ্যভিত্তিক বরাদ্দ বাড়ানোর মাধ্যমে নারী উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা।
মন্তব্য করুন