- চতুরঙ্গ
- প্রাণ ও অনুভূতির নদী কর্ণফুলী
প্রাণ ও অনুভূতির নদী কর্ণফুলী

চট্টগ্রামের প্রাণের নদী কর্ণফুলী। দেশের অর্থকরী নদী কর্ণফুলী। ২২০ বর্গকিলোমিটারের মহানগরীর গা ঘেঁষে বহমান অর্থকরী নদী কর্ণফুলী। পাহাড়ি খরস্রোতা ঐতিহ্য ও অহংকারের নদী। সংস্কৃতি ও সামাজিকতার নদী। সতেরো নৃগোষ্ঠীর সাম্য জলের জীবন্ত প্রবাহ এই নদী। চট্টগ্রামের মানুষের অনুভূতিকে লালন করা, ধারণ করা প্রবহমান রাখা নদী কর্ণফুলী। একটি নদী, একটি অনুভূতি। দীর্ঘদিন ধরে নদীটি বহুমুখী সমস্যা ও সংকট নিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরকে নিয়মিত জলকর দিয়ে যাচ্ছে উর্বর বিস্তৃত মোহনা অববাহিকার এ নদী।
নদীটির নাব্য সংকটে। পানির ধারণক্ষমতা কমে এসেছে ২০ শতাংশ। গড় গভীরতা দুই থেকে ৯ দশমিক ৫ মিটার। প্রস্থ কমানো হয়েছে ড্রেজিংয়ের নামে বেসাতি করে। কাটাছেঁড়ায় নদীটির সত্তা ও স্বকীয়তা সংকটাপন্ন।
ভূমিদস্যু, অপরাজনীতির উত্তরাধিকাররা, মাটিখেকোরা, পোশাকি সুশীলরা, অপশিল্পের শিল্পপতিরা নদীটিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আদালতের শরণাপন্ন হয়েও নদীটি আত্মরক্ষা, আব্রুরক্ষা, আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
এসবের কারণে জোয়ারের পানির উচ্চতা প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে। নগরের গড় উচ্চতার তুলনায় জোয়ারের জলের উচ্চতা ধারাবাহিকভাবে যাচ্ছে। পূর্ণিমা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে নদীটির অক্ষমতা প্রকাশিত হচ্ছে নিয়মিত। মোহনার মোহনীয় যে উর্বরতা, প্রডাক্টিভিটি, তা ব্যাহত হয়ে আসছে বহু বছর আগে থেকেই। আমরা যথার্থভাবে এসব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছি। মহাখননসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় দারুণভাবে কমানো হয়েছে এর প্রস্থ। লুট করা হয়েছে এর দেহ। অবৈধ দখল ক্রিয়া আছে সচল। দখলমুক্তি নীরবে-নিভৃতে বিলাপ করছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের অনুশাসন, নির্দেশনা অজ্ঞাত কারণে অদৃশ্যমান থেকে গেছে।
অর্থকরী নদী হিসেবে এর যে অবদান, তা আমরা বারবার ভুলে যাচ্ছি। অস্বীকার করছি।
নদীটিকে আগামী প্রজন্মের অহংকার হিসেবে শঙ্কা, সংকট ও বিপদমুক্ত, পরিচ্ছন্ন রাখা যাচ্ছে না।
ঢাকা থেকে নদীটিকে দেখা যাচ্ছে না। দেখার চেষ্টাও করা হচ্ছে না। ড্রেজিংয়ের নামে নদীটির সর্বনাশ করা হয়েছে। জলাতঙ্ক, জলাবদ্ধতার নগরী চট্টগ্রাম যেখানে বিপদাপন্ন, সেখানে কর্ণফুলী নদী বিপদমুক্ত থাকতে পারে না। এর সঙ্গে সম্পর্কিত পাহাড় কাটা-ছাঁটা, এর সঙ্গে সম্পর্কিত উন্নয়ন প্রকল্পের নামে মৃত্যুকূপ, মৃত্যুফাঁদ, তৈরি করা। এর সঙ্গে সম্পর্কিত চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা, জলাতঙ্কের সংকট। এই সংশয়, শঙ্কা, সংকট, নির্লিপ্ত, উদাসীনতা আমাদের বর্জন করতে হবে।
নদীটির সচল প্রবাহের সঙ্গে দেশের অর্থনীতির স্বপ্টম্নজয়ের প্রবাহ যুক্ত। বহু গুণে গুণান্বিত, বহু প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত, বহু জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাওয়া সামাজিক-সাংস্কৃতিক নদী কর্ণফুলী। নদীতে যেমন ধারণ করে বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস, তেমনি ধারণ করে ঐতিহ্য, অলংকার, অহংকার এবং জাতিসত্তার অহংকারের ঐতিহ্যকে।
দেশের সমুদ্রসীমার বৃদ্ধি, ব্লু-ইকোনমির স্বপ্টম্ন বাস্তবায়ন, ডেলটা পরিকল্পনার আশাজাগানিয়া ভবিষ্যৎ আমাদের তীব্রভাবে তাড়িত করে। মহেশখালী থেকে মিরসরাই পর্যন্ত ১৮৫ কিলোমিটার উন্নয়নের মহাকর্মযজ্ঞ দেশকে স্বপ্টম্নবাণ করে তুলেছে। এ নদীর বিস্তৃত দুই তীরের উন্নয়নযজ্ঞ এ দেশের মানুষকে দারুণভাবে আশাবাদী করে তুলেছে। এ স্বপ্টেম্নর বাস্তবায়নে কর্ণফুলীকে অবহেলা করার, প্রত্যাখ্যান করার কোনো সুযোগ নেই।
মহেশখালী এলএনজি ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণ এরই মধ্যে সম্পাদিত হয়েছে। দোহাজারী-কপবাজার, রামু, ঘুনধুম রেললাইনের কাজ ২০২২ সালে সম্পন্ন হবে।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প ২০২৩ সালে শেষ হবে। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল পুরোপুরিভাবে চালু হবে ২০৩০ সালে, যার দূরত্ব কর্ণফুলী মোহনা মুখ থেকে ৮৫ কিলোমিটার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর প্রকল্প বাংলাদেশের মানুষের কর্মসংস্থানের বড় সুযোগ করে দেবে। কর্মসংস্থান হবে ২০ লাখ মানুষের।
টেকনাফের সাবরাং এলাকায় ইটিজেড বা এপক্লুসিভ ট্যুরিস্টজোন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
কপবাজারের মহেশখালীতে অর্থনৈতিক অঞ্চল-৩ অফশোর এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশ থেকে ১৫ মিটার গভীর দিয়ে টানেল নির্মিত হচ্ছে। মূল টানেল লম্বায় ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। ব্যাস ১২ দশমিক ২৫ মিটার। প্রকল্প শেষ হবে ২০২২ সালে। এর মাধ্যমে আনোয়ারা উপজেলা যুক্ত হবে মূল মহানগরীর সঙ্গে। কর্ণফুলীর এই চ্যানেলের মাধ্যমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কপবাজার এশিয়ান হাইওয়ে হিসেবে চীনের কুনমিং শহরের সংযুক্তির মাধ্যমে রিজিওনাল কানেক্টিভিটি তৈরি করবে। চট্টগ্রাম কপবাজারের দূরত্ব কমে আসবে। এ চ্যানেল চালু হলে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলবে।
আনোয়ারা এলাকাসহ দক্ষিণ বাংলাদেশের সাগরতীরের শিল্পায়ন বিকশিত হবে। পর্যটনের দিগন্ত উন্মোচিত হবে। মাতারবাড়ী নির্মাণাধীন সমুদ্রবন্দর যুক্ত হবে চট্টগ্রামের সঙ্গে। মাতারবাড়ীর আমদানি-রপ্তানি পণ্য এই টানেল হয়ে পরিবাহিত হবে। এভাবেই কর্ণফুলীর চট্টগ্রাম হয়ে উঠবে নতুন অর্থনৈতিক করিডোর। আনোয়ারা, মহেশখালী, বাঁশখালী উপজেলায় তৈরি হবে নতুন নতুন শিল্পকারখানা। এরই মধ্যে কর্ণফুলীর ওপারের কোরিয়ান ইপিজেডসহ চায়নিজ আনোয়ারা এপপোর্ট প্রসেসিং জোন গড়ে উঠেছে।
দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কপবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের ঘুনধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটারের রেললাইন ২০২২ সালে শেষ হবে, যা ভবিষ্যতে চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া যুক্ত হয়ে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে।
আমরা এরই মধ্যে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের সমুদ্র পেয়েছি, যা দেশের আয়তনের ৮৩ ভাগ। তা ছাড়া বাংলাদেশের রয়েছে ৩৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের কোস্টাল এরিয়া। লয়েড জরিপে বিশ্বের ১০০ বন্দরের ৫৮তম ক্রমে উঠে আসা বন্দর চট্টগ্রাম সাম্প্রতিককালে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল বা পিসিটির তিনটি জেটির কাজ চলছে। বন্দরের বার জেটির সঙ্গে তিনটার যোজনে জেটি হবে ১৫টি। একেকটির দৈর্ঘ্য ৬০০ মিটার। এতে ১০ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের ১৯০ মিটারের তিনটি জাহাজ একসঙ্গে ভিড়তে পারবে এখানে।
অধিকন্তু লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল ও কর্ণফুলী কনটেইনার টার্মিনাল নামে চারটি টার্মিনাল ২০২৫ সালে কর্মক্ষম হবে। বড় জাহাজ থেকে লাইটারেজ দিয়ে কম সময়ে পণ্য খালাসের জন্য সদরঘাটে পাঁচটি লাইটার জেটি নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এখানে আরও ১৫টি লাইটার জেটি নির্মাণ করা হবে। এভাবে নদীর লালদিয়া, চান্দগাঁও, হামিদের ও সীতাকুণ্ড এলাকায় আরও ১৫টি লাইটার জেটি নির্মাণ করা হবে। সুতরাং আজ ও আগামীর কর্ণফুলীকে উন্নয়ন অগ্রগতির সঙ্গেই দেখতে হবে।
এ ছাড়া পতেঙ্গা ইপিজেডের পেছনে রাসমনি ঘাট পর্যন্ত সাগরপাড়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার বে-টার্মিনাল তৈরি করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের দ্বিগুণ আকারের এ টার্মিনালকে ক্রমান্বয়ে ছয় গুণ বাড়ানো হবে। জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর না থেকে চব্বিশ ঘণ্টা পণ্য ওঠানামা করানো হবে এখানে। বর্তমানে বন্দরে ১৯টি জাহাজ ভিড়তে পারলেও বে-টার্মিনালে ৩৫টি জাহাজ ভিড়তে পারবে। এখানে মাল্টিপারপাস টার্মিনাল ও জেটি হবে। এভাবেই চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর গুরুত্ব সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রীয় হাব কর্ণফুলী। সুতরাং কর্ণফুলীকে প্রত্যাখ্যান করা যায় না। যাবে না।
দেশে বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পগুলোর চারটির সম্পৃক্ততা এই কর্ণফুলীকে ঘিরে।
কর্ণফুলীর সুস্বাস্থ্যের সঙ্গে এ প্রকল্প এবং এ অঞ্চলের উন্নয়নের নিবিড় সংযোগ অবহেলা করার পর্যায়ে নেই। গভীর সমুদ্রবন্দর কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে টানেল সড়ক কর্ণফুলীর সংলগ্ন সমুদ্রতীরবর্তী দীর্ঘ অববাহিকার উন্নয়ন এ দেশের মানুষের স্বপ্টেম্নর সঙ্গে মিশে গেছে। রক্ত স্পন্দনের সঙ্গে স্পন্দিত হচ্ছে। একে রোধবার শক্তি কারও নেই।
কর্ণফুলীর প্রতি আমাদের প্রশাসনিক নির্লিপ্ততা, রাজনৈতিক উদাসীনতা, আঞ্চলিক রাজনীতি, ভূমিদস্যুদের বাড়াবাড়ি কোনোটিই শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে না।
মন্তব্য করুন