জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখিয়ে দেওয়া পররাষ্ট্রনীতি চর্চা করে আজ সব ক্ষেত্রে উন্নত বাংলাদেশ। 'সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়'- বঙ্গবন্ধুর এই নীতিকে ধারণ করে বরাবরই বাংলাদেশ থেকেছে জোটনিরপেক্ষ। কিন্তু বাংলাদেশের এই বন্ধুত্বকে দুর্বলতা ভাবা যে উচিত নয়, তা বেশ স্পষ্ট অনুভব করেছে চীন।

কোয়াড ইস্যুতে ১০ মে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং কূটনৈতিক প্রতিবেদকদের সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বাংলাদেশকে কোয়াডে যোগ দেওয়ার বিষয়ে সাবধান করেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কোনো মন্তব্য না করলে নিশ্চিতভাবেই দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠত। সেইসঙ্গে বিশ্বের বুকে দুর্বল রাষ্ট্র হিসেবেও সবার কাছে পরিচিতি পেত বাংলাদেশ। কিন্তু সেটি হয়নি। কেননা, বাংলাদেশ তার নিজ যোগ্যতা ও শক্তি সম্পর্কে জানে। আর সে কারণেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোয়াড নিয়ে যে মন্তব্য করা হয়, তা নিয়ে এক শীতল বাক্যবিনিময় চলে সিনো ও ঢাকার পররাষ্ট্র বিভাগে।

চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী উই ফ্যাঙ্গে ঢাকা সফরের পর হঠাৎ করেই লি জিমিং এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন। উই ফ্যাঙ্গে তার সফরে ভিন্ন অঞ্চলের সামরিক বাহিনীকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে প্রবেশের বিষয়ে নিরুৎসাহিত করার জন্য আলোচনা করেন। এ আলোচনা তিনি শ্রীলঙ্কা ও নেপালেও করেছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

লি জিমিং তার সাবধানবাণীতে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের কোয়াডের মতো ছোট একটি সংগঠনের সদস্য হওয়া উচিত নয়, কেননা এটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতির কারণ হতে পারে।' কিন্তু বাংলাদেশ বর্তমানে তার শক্তি সম্পর্কে জানে এবং এ কারণেই চীনের রাষ্ট্রদূতের এমন মন্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, 'সার্বভৌম একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তার নিজ দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য পররাষ্ট্রনীতি নিজেই ঠিক করবে।' সেইসঙ্গে বাংলাদেশে থাকা বিদেশি কূটনীতিকদের 'কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও আচরণের মধ্যে থাকা' এবং 'বিষয়গুলো বিবেচনা করে মন্তব্য করার' আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশের থেকেও চীনের কাছে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কথা শ্রীলঙ্কার। কেননা, দেশটির সঙ্গে চীনের ঋণ-সহায়তার সম্পর্ক রয়েছে, যা বাংলাদেশের সঙ্গে নেই। কিন্তু বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার থেকে পাঁচ ডলার কম মূল্যে ১০ ডলারে সিনোফার্মার টিকা বিক্রির প্রস্তাবে রাজি হয় চীন। সম্প্রতি টিকার মূল্য প্রকাশিত হওয়ার পর নতুন করে যা শোনা যাচ্ছে তা হলো, এরপর আর ১০ ডলারে টিকা দেবে না চীন। আর এ বিষয়কে কেন্দ্র করে আবারও সম্পর্কে ভাটা পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে চীন-বাংলাদেশের।

বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণের অর্থ কোন খাতে খরচ হচ্ছে, তা জানার অধিকার রয়েছে সবার। আর সে কারণেই বাংলাদেশকে এই কঠিন শর্ত দেওয়ার আগে বিষয়টি চীনের আরও ভালোভাবে বিবেচনা করে দেখা উচিত ছিল।

এদিকে, বাংলাদেশে চীনের টিকা স্বল্পমূল্যে দেওয়া নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে শ্রীলঙ্কায়। দেশটির বিরোধীদলীয় নেতা ড. হারসা দে সিলভা বলেছেন, বাংলাদেশের তুলনায় শ্রীলঙ্কা যে মূল্যে চীন থেকে টিকা নিচ্ছে, তাতে আমাদের ১৪ বিলিয়ন ডলার বেশি খরচ হবে। 'আমাদের বন্ধু হিসেবে চীন পরবর্তী চালানে টিকার মূল্য কমাতে পারে না?'- এমন প্রশ্ন করেছেন তিনি টুইটারে।

তবে শ্রীলঙ্কা যে চীনের প্রকৃত বন্ধু, তা প্রমাণ করেছে রাজাপাকসের সরকার। বাংলাদেশের সরকারি দপ্তর থেকে টিকার মূল্য নিয়ে তথ্য জানানোর পরও শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকার দাবি করেছে, ১০ ডলারে টিকা গ্রহণের বিষয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের এমন কোনো চুক্তিই হয়নি, বরং সম্পন্ন হওয়ার পথে রয়েছে। তারা সেটাই বলেছে, যা কলম্বোর চীন এমবাসি থেকে বলা হয়েছে।

অবশ্য তাতে চীনবিরোধী ক্ষোভ তেমন একটা কমেনি শ্রীলঙ্কায়। উল্টো সেখানে এ বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ লিখছে, শ্রীলঙ্কার বন্ধু (!) চীন এত দিন ধরে যা অর্থ সহায়তা করেছে, তা বেশি দামে টিকা সরবরাহের মাধ্যমে উসুল করে নিচ্ছে।

শ্রীলঙ্কার জনগণের এমন আস্ম্ফালনে অবশ্য খুব একটা বিচলিত নয় বেইজিং। কেননা এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কায় ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন সিনোফার্মার ডোজ সরবরাহ করেছে দেশটি। বিনিময়ে শ্রীলঙ্কার উত্তর প্রদেশে উইন্ডমিল প্রকল্প নিজেদের করে নিতে চায় চীন।

চীন বাংলাদেশকে স্বল্পমূল্যে টিকা সরবরাহ করছে- এমন তথ্য বারবার সামনে এলেও ভেতরকার তথ্যটা এখনও জানে না অনেকে। চীনের সিনোফার্মার টিকার মূল্য ভারতের অ্যাস্ট্রাজেনেক (কোভিশিল্ড) টিকার থেকে বেশি। অ্যাস্ট্রাজেনেকের প্রতিটি ডোজের মূল্য ৫ দশমিক ৫ ডলার। সেইসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, অ্যাস্ট্রাজেনেকের টিকা সিনোফার্মের টিকার থেকে অনেক বেশি কার্যকর। মধ্যপ্রাচ্যে সিনোফার্মার টিকার তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপ পর্যন্ত ব্যবহার করতে হচ্ছে, যেখানে অ্যাস্ট্রাজেনেকের টিকা দুই ডোজেই কাজ করছে। এ অবস্থায় সিনোফার্মার টিকার প্রকৃত ব্যয় কয়েক গুণ হতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকে। সেইসঙ্গে তাদের টিকার ওপর নির্ভর করেও থাকতে হতে পারে।

আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, চীনের ভ্যাকসিন অনেক দেশেই স্বীকৃতি পাচ্ছে না। এবার সৌদিতে হজ পালনের জন্য জনসন অ্যান্ড জনসন, ফাইজার, অ্যাস্ট্রাজেনেকাসহ আরও বেশ কিছু টিকা গ্রহণকারীকে অনুমোদন দিয়েছে সৌদি সরকার। কিন্তু চীনের ভ্যাকসিন গ্রহণকারীদের সেই অনুমোদন দেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে দারুণ বিপাকে রয়েছে পাকিস্তান।

তারপরও বাংলাদেশকে স্বল্পমূল্যে টিকা দেওয়ার কথা বলে সম্পর্ক উন্নয়নের যে চেষ্টা করা হয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত সফল হচ্ছে না।

যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গঠিত (আরও অনেক দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে) কোয়াড নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তায় রয়েছে চীন। আর সে কারণেই তার সঙ্গে উন্নয়ন কার্যক্রমে জড়িত দেশগুলোকে কোয়াডে যোগ না দেওয়ার জন্য বলছে দেশটি। এমনকি কোয়াডে যোগ দিলে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতে পারে বলেও দেশগুলোকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

চীন তার 'পার্ল ট্রেড' নীতি নেপাল থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। মধ্যখান থেকে বাদ থাকছে ভারত। আর চীনের এই নীতিমালায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। কেননা, এখান থেকে আরব সাগর পর্যন্ত যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু ক্ষেত্রে দ্বিমত থাকলেও দু'দেশের মধ্যকার সম্পর্ক বেশ আন্তরিক। আর এ বিষয়টিকে মোটেও ভালোভাবে দেখছে না চীন।

চীনের থেকে ঋণ নিতে রাজি না হওয়ার পরও গত এক বছরে বাংলাদেশকে ১০ হাজার টেস্টিং কিট, ১০ হাজার সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) এবং এক হাজার থার্মাল স্ক্যানার প্রদান করেছে চীন। বাংলাদেশ কভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় এই উপহার গ্রহণ করলেও বেশ কৌশলে চীনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' প্রকল্পকে নাকচ করেছে। বাংলাদেশে দৃঢ় নেতৃত্বের অধিকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াকে সংযুক্ত করে এমন এক বড় প্রকল্পে নিজেদের যুক্ত রাখতে চান, যা চীনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' প্রকল্পের মাধ্যমে সম্ভব নয়। আর সে কারণেই চীনের আর্থিক সহায়তা প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করেনি বাংলাদেশ। নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ চীনের যে নীতির শিকারে পরিণত হয়েছে, তা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতেই চীনের কাছ থেকে দ্রব্যসামগ্রী বা প্রযুক্তিগত সহায়তা নিলেও আর্থিক কোনো সহায়তা নিতে রাজি হয়নি বাংলাদেশ; বরং বাংলাদেশ তার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্পের কাজগুলো সম্পাদন করছে। এ জন্য বাংলাদেশ বেছে নিয়েছে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কার্যক্রম।

২০১৬ সালে বাংলাদেশে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের সময় বেশ কিছু সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু চীন থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ সাবধান থেকেছে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশে চীনের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাতিলের পাশাপাশি চীনের বেশ কিছু ফার্মকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, যার খবর দেশের জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

বিপদগ্রস্ত দেশগুলোর সঙ্গে চীনের 'ভ্যাকসিন কূটনীতি' যেভাবে কাজ করেছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হীতে বিপরীত হতে পারে। বাংলাদেশ বাস্তবিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে তার নীতিনির্ধারণ করছে। নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে এত দিন পরিচালিত হয়েছে বাংলাদেশ, যার সুফলও ভোগ করছি আমরা। ঢাকা শ্রীলঙ্কাকে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ-সহায়তা দিচ্ছে, যা স্পষ্টতই বলছে যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের জিডিপি বর্তমানে ৮৫ বিলিয়ন, যেখানে কলম্বোর বর্তমান জিডিপি মাত্র তিন বিলিয়ন।

চীনের ঋণের বেড়াজাল থেকে যখন শ্রীলঙ্কা মুক্তি পাবে, ততদিনে বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়ে যাবে। কারণ, ঢাকা তার পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবতার নিরিখে তৈরি করে এগিয়ে গেছে। ঢাকা জানে, কোন দেশের মুঠোর মধ্যে না থেকেও উন্নয়ন করা সম্ভব। বরং শ্রীলঙ্কার এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের থেকে কিছু শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।

আর 'কোয়াড' নিয়ে বাংলাদেশকে চাপে রাখতে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত মন্তব্য করছেন, সে বিষয়টি বর্তমানে স্পষ্ট। বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে শীতল যে বাক্যবিনিময় হয়েছে, তা চীনের 'টিকা রাজনীতি'দিয়েও উষ্ণ করা সম্ভব হয়নি। দেখার বিষয় হলো, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে এবার কোন নীতির আশ্রয় নেয় চীন।