১৬ জুন নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের বঙ্গবন্ধু লাউঞ্জে জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার-বিষয়ক বিশেষ দূত ক্রিস্টিন এস. বার্গনারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠককালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, 'মানবিক বিবেচনায় আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। তবে এই সঙ্কটের সমাধান নিহিত রয়েছে মিয়ানমারে তাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের ওপর, যা গত চার বছরে সম্ভব হয়নি। আমরা চাই প্রত্যাবর্তন বিষয়ে জাতিসংঘ স্পষ্ট একটি রোডম্যাপ তৈরি করুক।' ( সমকাল, ১৭ জুন ২০২১)।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে বিষয়ে দীর্ঘ চার বছর ধরে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে লেখার সময় মনে পড়ে গেল নাসিরুদ্দিন হোজ্জার 'বিবি তোমার কথাই ঠিক' গল্পটি। হোজ্জা তখন কাজি। বিচার-আচার করেন। এক দিন বিচারে বসেছেন। ফরিয়াদি আসামি সম্পর্কে তার অভিযোগের বয়ান দিচ্ছে। হোজ্জা মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছেন। বাদীর বলা শেষ হলে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, 'তোমার কথাই ঠিক।' এবার আসামি বলে উঠল, 'হুজুর, আমার দুইটা কথা ছিল।' হোজ্জা বললেন, 'ঠিক আছে তুমি তোমার বক্তব্য বল।' আসামির বক্তব্যও মনোযোগ দিয়ে শোনার পর হোজ্জা বললেন, 'তোমার কথাই ঠিক।' হোজ্জার স্ত্রী পর্দার আড়ালে এতক্ষণ সব কথা শুনছিলেন। বিরক্ত হয়ে স্বামীকে তিনি বললেন, 'দুজনই ঠিক হয় কীভাবে? হয় আসামির কথা ঠিক, না হয় ফরিয়াদির কথা ঠিক।' হোজ্জা স্ত্রীর দিকে ফিরে সমর্থনসূচক হাসি দিয়ে বললেন, 'বিবি তোমার কথাই ঠিক।'

রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বিষয়ে জাতিসংঘের বর্তমান অবস্থা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার 'বিবি তোমার কথাই ঠিক' গল্পের মতো। যখনই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে বলা হলো, জাতিসংঘ বলে ওঠে 'তোমার কথাই ঠিক।' আবার মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বললে বলে, 'তোমার কথাই ঠিক।' আবার পেছন থেকে চীন বা ভারতের মতো দেশ মতামত দিলে জাতিসংঘের উত্তর 'তোমার কথাই ঠিক।'

বিগত প্রায় চার বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমার তাদের দেশে ফেরত নেয়নি। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে মিয়ানমারকে কোনো চাপ প্রয়োগ না করে বরং সবসময় স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে খেয়াল রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আবার মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বিষয়ে তো আশ্বাস চলমান আছে। ১৯ জানুয়ারি মিয়ানমারের তৎকালীন আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী কাইয়া টিন জানান, ২০১৭ সালে দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। একই সঙ্গে বাংলাদেশসহ সব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও পারস্পরিক স্বার্থসংশ্নিষ্ট বিষয়ক সমস্যা সমাধানেও তার দেশ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। (সমকাল, ২২ জানুয়ারি ২০২১)। আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি নিয়ে মিয়ানমার সরকার বরাবরই খেলে চলেছে।

সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এ বছরের ১ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিকভাবে মিয়ানমারের পট পরিবর্তন হওয়ায় নতুনভাবে ধাক্কা খেলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে বারবার। কিন্তু তারা মানবিক সহায়তার বিষয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করে চলেছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করে চলেছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের সব ধরনের মানবিক সহায়তা চলমান। রোহিঙ্গাদের জীবনযাত্রার মান আরও উন্নয়নের লক্ষ্যে ভাসানচরে গড়ে উঠেছে পরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প। যেখানে রয়েছে সব নাগরিক সুবিধা। এত নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার পরও কিছু কিছু মানবাধিকার সংগঠন কঠোর সমালোচনা করে চলেছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের বিষয়ে যতটা সোচ্চার, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে রয়েছে ততটাই নীরব ভূমিকায়। শুধু সংগঠনই নয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে চীন, ভারত, জাপানের মতো রাষ্ট্রের নীরবতা তৈরি করেছে অন্ধকারের ঘোর অমানিশা। জাতিসংঘ সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন বিবদমান বিষয়ের সমাধানের সবচেয়ে শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম। 'রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের' বিষয়ে জাতিসংঘের ভূমিকাও দৃশ্যমান নয়। এরও প্রমাণ মেলে সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ থেকে। গত ৩০ মে থেকে ২ জুন পর্যন্ত চার দিনের বাংলাদেশ সফরে আসেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের দু'জন সহকারী কমিশনার সহকারী হাইকমিশনার রউফ মাজাও ও গিলিয়ান ট্রিগ। সফরের অংশ হিসেবে তারা কপবাজার ও ভাসানচরে ভ্রমণ করেন। ৩১ মে ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধিরা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের দেখতে যান। 'রোহিঙ্গাদের তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানো যেতে পারে!', 'ভাসানচরের পরিবেশ কপবাজার ক্যাম্পের চেয়ে অনেক ভালো', 'রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘের সহযোগিতা থাকবে'- এ ধরনের বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে তাদের সফরকে কেন্দ্র করে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশের বিষয়ে আলোকপাত করেননি। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়নি।

সাম্প্র্রতিক সময়ে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে সত্যিই হতাশাজনক। চার বছর ধরেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে জাতিসংঘ কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করছে না, এমনকি মিয়ানমারের ওপর কোনো দৃশ্যত চাপ প্রয়োগ করছে না 'কফি আনান কমিশনের' সুপারিশ বাস্তবায়নের। যখনই বাংলাদেশ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্প্র্রদায়ের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা বিষয়ে তাদের অবহিত করা হয়, তখনই একটু নড়েচড়ে বসে। যা হোক, এ প্রসঙ্গে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার আরও একটি গল্পের কথা বলি। গল্পটি হলো- 'তাহলে আমি ঘুমাচ্ছি'।

একদিন হোজ্জা চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। এমন সময় তার বউয়ের ছোট ভাই এলো। বউয়ের ছোট ভাই : আপনি কি ঘুমাচ্ছেন? হোজ্জা : কেন জিজ্ঞেস করছ? বউয়ের ছোট ভাই : আপনি যদি আমাকে কিছু টাকা ধার দিতেন। হোজ্জা : তাহলে আমি ঘুমাচ্ছি। এখন আমাকে একা থাকতে দাও।

জাতিসংঘের কাছে 'রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের' বিষয়ে অবহিত করা হলে ফলাফল 'তাহলে আমি ঘুমাচ্ছি' গল্পের হোজ্জার মতো। দীর্ঘ চার বছর তো চলে গেল। দেখা যাক, কবে জাগ্রত হয় জাতিসংঘ এবং স্পষ্ট একটি রোডম্যাপ তৈরি করে 'রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের' বিষয়ে!