নিত্যদিনের মতো সেদিনও ব্যস্ততার মাঝে সময় কাটছিল। দুপুর ১টার দিকে হঠাৎ সময় টিভির সাংবাদিক ও বন্ধু আশিকের টেপট এবং কল পেলাম। জানাল বিকেল সাড়ে ৩টায় মিলফোনতেস যাবে, আমাকেও যেতে হবে। পর্তুগাল প্রবাসী সংবাদকর্মীদের একটি দলের সঙ্গে লিসবন থেকে ১৯০ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট শহর মিলফোনতেস ভ্রমণের জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। দ্রুত গুগল করে শহরটি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেলাম। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আশিককে জানালাম, তাদের সঙ্গে আমিও মিলফোনতেস যেতে চাই। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ শেষ করে পৌনে ৫টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম আশিকের বাসায়। ৬টা নাগাদ সেখান থেকে বেরিয়ে মোটামুটি সাড়ে ৬টায় আমাদের আরও দুই সফরসঙ্গী রনি মোহাম্মদ ভাই এবং রাসেল আহমেদকে নিয়ে রওনা হলাম দক্ষিণের শহর মিলফোনতেসের উদ্দেশে।

মিলফোনতেসের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাংলাদেশ কমিউনিটির সাধারণ সম্পাদক সুমন খান আমাদের যাত্রার বন্দোবস্ত করেছেন। লিসবন থেকে নিজে ড্রাইভ করে আমাদের নিয়ে তিনি রওনা হলেন। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতোই পর্তুগালের হাইওয়ে নিশ্ছিদ্র ও স্মুথ। এক রকম গতির ঝড় তুলে আমরা রওনা দিলাম গন্তব্য অভিমুখে। মাঝপথে একটি ক্যাফেতে ২০ মিনিটের সংক্ষিপ্ত কফি ব্রেক নিলাম। তারপর আবার যাত্রা শুরু করে মোটামুটি পৌনে ৯টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্য ভিলা নোভা দ্য মিলফোনতেসে।

সেখানে আমাদের রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল। সুমন খান আমাদের সোজা হোটেলে নিয়ে গেলেন। আমরা ফ্রেশ হয়ে রাত সোয়া ৯টা নাগাদ বের হলাম রাতের শহর দেখার উদ্দেশ্যে। শুরুতেই ব্যবসায়ী সুমন খানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখলাম। তিনি তার মিনি মার্কেটকে অত্যন্ত যত্ন করে গড়ে তুলেছেন। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সব কিছুই সেখানে মজুদ থাকায় তিনি পর্তুগালের জনপ্রিয় ব্র্যান্ডেড মিনি মার্কেট 'মিনি প্রেসো'র সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ব্যবসা করছেন।

রাতের মিলফোনতেসের সৌন্দর্য দেখার মনোবাসনা নিয়ে আমরা রওনা হয়ে গেলাম। মিলফোনতেসে পর্তুগিজ গ্রীষ্মে দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য পর্যটকের আগমন ঘটে। তাই শহরজুড়ে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন হোটেল ও রেস্তোরাঁ। মিলফোনতেস ঘুরতে আসা বিভিন্ন পর্যটক তখন রেস্তোরাঁগুলোতে রাতের আহার সারছেন। কেউবা প্রিয়জনের সঙ্গে গল্পে মেতে একান্তে সময় কাটাচ্ছেন। আমরা শহরের গলিপথ ধরে মিনিট দশেক হেঁটে পৌঁছে গেলাম সমুদ্রসৈকতের ধারে। দ্রুতই মোবাইল ক্যামেরায় কিছু নাইট-সাইট ফটোগ্রাফি করলাম। রাতের মিলফোনতেস আমার কাছে ধরা দিল অপার সৌন্দর্যের রূপে। সেখানে কিছু সময় গল্প-আড্ডা দিয়ে আবার ফিরে এলাম হোটেলের কাছে। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল ৭টায়। ৯টা নাগাদ হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। শুরুতেই আমরা গেলাম স্থানীয় বড় মার্কেটে। সেখানে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন আরিফ হোসেন রিগ্যান। তিনিও নামকরা ব্যবসায়ী। তরুণ এই ব্যবসায়ী ফিউচার গুরু নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন নিজের উদ্যোগে। সুমন খানের গাড়িতে আশিক ও আমি চড়ে বসলাম। আর আরিফ হোসেনের যাত্রাসঙ্গী হলেন রনি মোহাম্মদ ও রাসেল আহমেদ। আশিক সময় টিভির জন্য অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে এসেছে। রনি মোহাম্মদ ডিবিসি নিউজের পর্তুগাল প্রতিনিধি। তারও অফিসিয়াল কাজ। অন্যদিকে রাসেল আহমেদ এটিএন বাংলা ও ডেইলি স্টারে কাজ করেন। তাদের প্রফেশনাল অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি সবার মাঝে একমাত্র ব্যক্তি যে কোনো অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে আসিনি। ঘুরতে ও দেখতে এসেছি। তাই মনের আনন্দে ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে শুরু করলাম।

শুরুতেই মিলফোনতেস থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের একটি কৃষি ফার্মে গেলাম। র‌্যাপসবেরির সেই ফার্মে জনবল সরবরাহের দায়িত্বে আছেন সুমন খান। সেখানে দক্ষিণ এশীয় কর্মীরা কাজ করেন। অনেক বাংলাদেশিও আছেন তাদের মধ্যে। আমরা ঘুরে ঘুরে র‌্যাপসবেরির চাষ দেখলাম। নিয়ন্ত্রিত গ্রিনহাউস পরিবেশে সেখানে র‌্যাপসবেরির চাষ হয়। গাছ থেকে পেড়ে দু-একটি র‌্যাপসবেরির স্বাদ নিলাম। অসাধারণ সেই স্বাদ। এরপর কথা বললাম বাংলাদেশি কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে। তারা জানালেন, এখানে তারা ভালো সম্মানীতে কাজ করেন। কোম্পানি থেকে তাদের বাসস্থান ও খাবারের সংস্থান করা হয়। বাসস্থান থেকে ফার্মে যাতায়াতের দায়িত্বও কোম্পানির। তারা কৃষিক্ষেত্রে কাজ করে বেশ ভালো আছেন। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে কাটালাম আমরা। এরপর আরিফ হোসেন আমাদের নিয়ে গেলেন আরেকটি র‌্যাপসবেরি ফার্মে। সেখানে জনবল নিয়োগের দায়িত্ব তার। আমরা কথা বললাম ফার্মে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীদের সঙ্গে। আমার সহযাত্রী ও সাংবাদিকরা তাদের কাজ সম্পন্ন করলেন। কয়েকজন কর্মী ও ফার্মের ম্যানেজারের ইন্টারভিউ নেওয়া হলো। আমরা জানতে পারলাম, এখানে এখনও কাজের জন্য কর্মী নেওয়া হচ্ছে। পর্তুগালে অবস্থানরত বাংলাদেশি কাজবিহীন লোকেরা মিলফোনতেসে কাজের সন্ধানে যেতে পারেন।

র‌্যাপসবেরি ফার্ম থেকে বের হতে দুপুর দেড়টা। তখন আমরা সবাই ক্ষুধা অনুভব করতে শুরু করেছি। সুমন খান আজ ভিন্ন কিছু খাওয়াতে চান। আমরা চলে গেলাম স্থানীয় একটি নেপালি রেস্তোরাঁয়। সেখানে দুই প্রকার মমো পাওয়া যায়। এটি নেপালের জনপ্রিয় একটি খাবার। আমরা প্রত্যেকে ১০টি করে মমো খেলাম। এরপর আমরা বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশে। মিরা নদী ও আটলান্টিক মহাসাগরের মোহনায় সেই সমুদ্রসৈকত। লিসবনের চেয়ে অনেক নিরিবিলি তবুও অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটকে ভরপুর এখানকার সমুদ্রসৈকত। ঘুরতে আসা অ্যাডাল্টদের অধিকাংশই সেখানে সামুদ্রিক পোশাকে রোদ্রস্নানে ব্যস্ত। আর শিশুরা বালুতে নানা রকম খেলায় মেতে উঠেছে। সমুদ্রের নীলাভ জলরাশি, রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ আর সবুজ স্নাত বৃক্ষমঞ্জুরিশোভিত মিলফোনতেসের বর্ণনা দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন।

অ্যাসাইনমেন্টের কাজ সবাই শেষ করে ফেলল। এবার আমাদের মিলফোনতেস শহরে আবার ফিরে যাওয়ার পালা। সেখানে গিয়ে ব্যবসায়ী সুমন খানের মিনি মার্কেট এবং মোবাইল শপের ছবি ও ভিডিও ধারণ করা হলো। বন্ধু আশিক সেখানে একটি রিপোর্ট করল। মূলত বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মজীবন নিয়ে সে একটি রিপোর্ট করল। রনি মোহাম্মদ ও রাসেল আহমেদও তাদের মতো করে কাজ করলেন।

আমাদের ফেরার বাস ছিল ৫টায়। আমরা তাই দ্রুতই সব কিছু গুছিয়ে বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে রওনা দিলাম। কিছুটা বিলম্বে সাড়ে ৫টায় আমাদের বাস এলো। এখানে বাসে কোনো কন্ট্রাক্টর থাকে না। চালকই সব দায়িত্ব পালন করেন। তাকে মোবাইলে ইলেকট্রনিক টিকিট দেখিয়ে উঠে গেলাম বাসে। আমাদের এই যাত্রার সব আয়োজনই করেছেন সুমন খান। তিনি ও আরিফ হোসেন আমাদের বাসে তুলে দিতে এসেছিলেন। তাদের বিদায় ও ধন্যবাদ জানালাম। আমরা চারজন রওনা দিলাম লিসবনের উদ্দেশে। প্রায় তিন ঘণ্টা ২০ মিনিটের যাত্রা শুরু হলো। পড়ন্ত বিকেলের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করে পৌনে ৯টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম লিসবনের সেতে-রিওস বাসস্ট্যান্ডে। এবার যার যার বাসার পথে মেট্রো ধরে রওনা দিলাম।

পর্তুগালের মিলফোনতেস ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি আমার আজীবন স্মরণ থাকবে। ছোট্ট অথচ ছিমছাম একটি শহর এটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভিলা নোভা দ্য মিলফোনতেস। পাঠক, আপনারাও আমাদের মতো ঘুরে আসতে পারেন এই শহরে। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আপনাদের স্মৃতিতে দারুণ একটি অভিজ্ঞতার সঞ্চার হবে।