- চতুরঙ্গ
- 'প্রতিদ্বন্দ্বী' চলচ্চিত্রের সিদ্ধার্থ: একাল ও সেকাল
'প্রতিদ্বন্দ্বী' চলচ্চিত্রের সিদ্ধার্থ: একাল ও সেকাল

ষাটের দশকের উত্তাল কলকাতা। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর এই শহরে শরণার্থী সমস্যা চলমান। সমাজজুড়ে নানান অস্তিত্ববাদের সংকট। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সমাজের প্রতিটি স্তরে নৈতিকতার স্খলন।
এরই সঙ্গে ষাটের দশকের নকশালপন্থি আন্দোলন। তরুণদের একাংশ শ্রেণিদ্বন্দ্বের এই সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে অংশ নিচ্ছে বিতর্কিত বিপ্লবে। আরেকটি অংশ বেকারত্বের প্রাত্যহিক সমস্যায় জর্জরিত। এমনই এক উত্তাল নগরীর বৈরী আবহাওয়ায় বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে নির্মিত হয় ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ চলচ্চিত্রটি। কালজয়ী লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৭০ সালে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরিচালক সত্যজিৎ রায়।
সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ‘কলকাতা ত্রয়ী বা ট্রিলজি’র প্রথম চলচ্চিত্র এই 'প্রতিদ্বন্দ্বী', যেখানে আমরা দেখতে পাই শিক্ষিত এবং একই সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন প্রতিকূলতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত এক তরুণ সিদ্ধার্থ চৌধুরীকে (ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়)। কলকাতা শহরের সেই অস্থির সময় শুধু সিদ্ধার্থর মতো তরুণদেরই নয়, প্রভাবিত করছে সব শ্রেণির মানুষকে, গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে।
সিদ্ধার্থর মতো তরুণ আমরা প্রতিটি সমাজেই দেখতে পাই। হোক তা ষাটের দশকের নকশালপন্থি বিতর্কিত আন্দোলনের জোয়ারে কিংবা আধুনিক প্রযুক্তির একালের সমাজে। কে এই সিদ্ধার্থ? ‘প্রোটাগনিস্ট’ (Protagonist) এই চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্দ্বী চলচ্চিত্রটি আবর্তিত হতে দেখি। সিদ্ধার্থ চৌধুরীর বর্তমান পরিচয়- একজন চাকরিপ্রত্যাশী যুবক, যে প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে এবং তার আশপাশের চরিত্রগুলোর সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত কলকাতা নগরীতে যেখানে ভোগবাদী যান্ত্রিক সভ্যতা এবং একইসঙ্গে মূল্যবোধের অবক্ষয় বিরাজমান। শুধু ভারতবর্ষ নয়, পুরো পৃথিবীতেই চলছে রাজনৈতিক এক অস্থিরতা। সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্ত হবার জন্য দেশে দেশে চলছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এমনই এক অস্থবির সময়ে বাবার মৃত্যুতে বাধ্য হয়ে মেডিকেল কলেজের দু’বছর শিক্ষাজীবন মুলতবি দিয়ে তাকে বের হতে হয় চাকরির সন্ধানে।
মহানগরীর এই রাজপথে হেঁটে হেঁটে তাকে করতে হচ্ছে জীবিকার অনুসন্ধান; কিন্তু কোথাও তো একটা ব্যবস্থা হচ্ছে না! উপরন্তু চাকরির এক সাক্ষাৎকারে ভিয়েতনামের যুদ্ধকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করায় তাকে প্রশ্নকর্তার সন্দেহের মুখে পড়তে হয়। ‘সিদ্ধার্থ বামপন্থি নয়তো?’ সে সময়ে একদিকে উত্তাল নকশালপন্থি আন্দোলনের বিতর্কিত জোয়ার, আরেকদিকে ভোগবাদী সমাজের শক্তিশালী উত্থান।
এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে সিদ্ধার্থের চাকরিটাও হাতছাড়া হয়ে গেল! পরবর্তী সময়ে তারই এক বন্ধুর যুক্তি, ‘বুঝলি, প্রশ্নকর্তারা ঠিক যেভাবে চায়, সেভাবে উত্তর দিলে চাকরিটা আসলে পাওয়া যায়’। সিদ্ধার্থের বন্ধুর এই যুক্তি কিন্তু সেই ষাটের দশক পেরিয়ে এখনও প্রবলভাবে বিদ্যমান। আমরা আমাদের ভোগবাদী সমাজের ক’টা জিনিসকে বা আসলে প্রশ্ন করি? বরং এখানে শিক্ষিতের তুলনায় যোগ্য কর্মসংস্থানের সংখ্যা অপ্রতুল। হয় তুমি আপস করো, কর্তা-ব্যক্তিদের মনোরঞ্জন করে চলো, নয়তো নিজের সততার সঙ্গে তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে অনিশ্চয়তা নিয়ে।
সিদ্ধার্থের এই দ্বন্দ্ব কেবল ঘরের বাইরেই নয়, এই সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও। তারই ছোট বোন সুতপা এই চাকচিক্যময় সমাজে যোগ্যতা এবং মেধার চেয়ে সৌন্দর্যকে অধিক গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে। আবার সিদ্ধার্থেরই আরেক ছোট ভাই নকশাল বিপ্লবের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। অথচ সিদ্ধার্থ এই দুই পক্ষের কোন পক্ষেরই তো নয়। না সে চাকচিক্যের সমাজে এতদিনের গড়ে তোলা মূল্যবোধের অবক্ষয় করতে পারছে, না সে তার সহোদরের মতো সরাসরি বিপ্লবে যোগদান দিতে পারছে। তাকে তো প্রতিনিয়ত চাকরির খোঁজ করতে হচ্ছে। তাই সে তার সহোদর টুলুকে চে-গেভারার উপর একটি বই দিলেও নিজে টুলুর মতো এত দৃঢ়ভাবে বেছে নিতে পারে না এই রাজনৈতিক মতাদর্শ। কল্পনা কিংবা শুধু মানসিক জগতেই সিদ্ধার্থ চে’র রূপ নিতে পারে। কল্পনাতেই সে শুধু বোনের বস স্যা্ন্নালকে গুলি করতে পারে।
চলচ্চিত্রের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে আমরা সিদ্ধার্থকে দেখি একেকটি মানসিক লড়াইয়ে লিপ্ত হতে। পরিবার থেকে শুরু করে চাকরির ইন্টার্ভিউ, বন্ধু, বোনের বস, সস্তা বিনোদনের খোরাক, সমাজ এই প্রতিটি পদে সিদ্ধার্থকে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে হয়েছে। এই দ্বন্দ্ব এতদিনের মূল্যবোধ আর সমাজের অবক্ষয়ের। এই দ্বন্দ্ব প্রতিদ্বন্দ্বী চলচ্চিত্রকে ছাপিয়ে আমাদের নিত্যদিনের। আমরাও এই আধুনিকতার ছাঁচে গড়া সমাজে সিদ্ধার্থের মতোই অনুপস্থিতি বোধ করি নৈতিকতার এবং মানসিক স্বস্তির। যেখানে সিদ্ধার্থের মতো শত সহস্র অনেককেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয় ঠিক-বেঠিকের দোলাচলে।
জনসমুদ্রের এই স্রোতে আমরা প্রত্যেকেই একেকটি প্রোটাগনিস্টের চরিত্র রূপায়ণ করি। শেষমেশ কথা হল, দিনের অস্তভাগে আমরা কতটা নিজ মূল্যবোধের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারি! হয়তো সিদ্ধার্থের মতোই ভেতরকার যে ক্ষোভ সেটাও ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’র মধ্য দিয়ে আপস করা হয়ে যায়।
মন্তব্য করুন