সারাবিশ্ব করোনাকালীন এক কঠিন সময় পার করছে। যার কারণে গত বছর থেকে বন্ধ আছে অধিকাংশ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে সীমিত পরিসরে দাপ্তরিক কাজ-কর্ম শুরু হলেও স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় শুরু করা যায়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সরাসরি পাঠদান। কয়েকবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও করোনার নতুন নতুন ধরন বিশেষ করে ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট সারাবিশ্বে নতুনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। যার প্রভাব প্রকটভাবে পড়েছে আমাদের এই দেশে।

প্রথমদিকে অনলাইন ক্লাসের জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় উপকরণ কিংবা প্রশিক্ষণ না থাকলেও বর্তমানে গ্রাম থেকে শহর এবং প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা- সর্বক্ষেত্রে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন শ্রেণি কার্যক্রম না থাকায় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে যে নিবিড় বন্ধন, তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাই শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী কেউই ভালো থাকতে পারছেন না। বাংলাদেশে কয়েকটি মাধ্যমে লেখাপড়া হয় যেমন বাংলা ও ইংলিশ মিডিয়াম। যেসব স্কুলে অক্সফোর্ড কিংবা ক্যামব্রিজের পদ্ধতি অনুসরণ করে পড়ানো হয়, সেখানে করোনা মহামারির প্রথম থেকে নিয়মিত ক্লাস এবং পরীক্ষা হচ্ছে।

বাংলা মাধ্যমেও অনেক প্রতিকূলতার মাঝে অনলাইন ক্লাস নেওয়া এবং টিউটোরিয়াল বা অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতে পারি, গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গুগল মিটের মাধ্যমে ক্লাস চালাচ্ছেন। অনেক সিনিয়র শিক্ষক, যারা কোনোদিন কম্পিউটার অথবা স্মার্টফোন বা সমপর্যায়ের অন্য কোনো ডিভাইস ব্যবহার করেননি; বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকরা নিয়মিত বেতন না পেলেও এই ডিভাইস কিনে ক্লাস নিচ্ছেন। এমনকি শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তাদের সাধ্যমতো অনলাইন ক্লাস নেওয়ার চেষ্টা করছেন, যদিও গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারে না। কারণ তাদের মোবাইল নেটওয়ার্ক ভালো না। আবার কারও প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই কিংবা ইন্টারনেটের খরচ চালাতে পারছে না।

বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতিদিন সকাল থেকে আমাদের কোমলমতি সন্তানরা বাসায় ক্লাস করছে এবং তাদের শিক্ষকরা অনলাইন ক্লাস নিচ্ছেন। অনলাইন ক্লাসের কারণে আমাদের সন্তানের হাতে অল্প বয়সে তুলে দিতে হচ্ছে মোবাইল বা ল্যাপটপ। সারাদিন অনলাইনে ক্লাস করা খুবই কষ্টের, তবুও করতে হচ্ছে।

দীর্ঘ সময় অনলাইনে থাকার কারণে তাদের মানসিক এবং শারীরিক বিকাশে ব্যাঘাত হতেও পারে। অনেক কষ্টে দেশের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু দেশ-বিদেশে প্রচারিত হচ্ছে, বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৭/১৮ মাস বন্ধ। গত বছর জুলাই থেকে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস চলছে। সেই সঙ্গে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন কিংবা সরাসরি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ওয়েবিনার, কনফারেন্স, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের নিয়মিত আয়োজন করা হচ্ছে এবং শিক্ষকরা আন্তর্জাতিক ই-কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করে প্রবন্ধ উপস্থাপন করছেন। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট শিক্ষকরা নিয়মিত অফিস করছেন। করোনাকালে গবেষকরা আগের তুলনায় অনেক বেশি গবেষণাধর্মী আর্টিকেল প্রকাশ করছেন।

বিদেশে থাকা বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগে জানতে পারি, বিশ্বের অনেক দেশেই অনলাইন শিক্ষাক্রম চলছে। কিন্তু আমাদের দেশে ক্লাস এবং নিয়মিত মূল্যায়ন হলেও বলা হচ্ছে- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ। এ কারণে দেশের আপামর জনগণ এবং অভিভাবকরা মনে করেন, শিক্ষকরা বসে বসে বেতন নিচ্ছেন এবং সমাজের চোখে সম্মানিত শিক্ষকরা ভিন্নভাবে মূল্যায়িত হচ্ছেন। এর ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকরা খুবই বিব্রত।

সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা এবং শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে নিরলস কাজ করছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের বুলেটিন এবং মন্ত্রণালয়ের সার্কুলার অনুযায়ী দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনেক দিন ধরে বন্ধ আছে। এ নিয়ে সরকারও বিব্রত। পর্যালোচনা করে দেখবেন, শিক্ষামন্ত্রী যখন ১৫ দিন কিংবা ১ মাস পরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেন তখন তাকে স্বাভাবিক মনে হয় না। কারণ শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে পারছেন না। কিন্তু সশরীরে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমদের দেশের শিক্ষা কার্যক্রমও অনলাইনে চলছে।

এটা মানতে হবে, আমদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের থেকে অনেক ভালো। কিন্তু এখনও উন্নত বিশ্বের তুলনায় পিছিয়ে। করোনার এই সময়ে অনেক পরিবারে এখন দৈনিক খাবার জোগাড় করা দুরূহ, তার ওপর অনলাইন ক্লাসের বাড়তি উপকরণ। বর্তমান অবস্থায় পদে পদে মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে শ্রেণিভেদে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এতে ওইসব শিক্ষার্থীর কোনো দোষ নেই। এটি আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ।

প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশে করোনার টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা প্রদান করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, সবাইকে টিকা দিয়ে নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম শিগগিরই আরম্ভ করা যাবে।

করোনার উচ্চ সংক্রমণের কারণে এ বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা সময়মতো নেওয়া যাচ্ছে না এবং অ্যাসাইনমেন্ট ও গ্রুপভিত্তিক কিছু পরীক্ষা নিয়ে মূল্যায়ন করার পরিকল্পনার বিষয়টি আমরা জেনেছি। এ কার্যক্রমেও শিক্ষকরা সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করছেন।

পরিশেষে বলতে চাই, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ছুটি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সব সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আবারও বাড়ছে। কিন্তু বলা উচিত- সরাসরি শ্রেণি কার্যক্রম আগামী ১৫ দিন কিংবা ১ মাসের আগে শুরু করা যাচ্ছে না। যার মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনলাইন কার্যক্রম মূল্যায়ন করা হবে। সমাজের চোখে সম্মানিত শিক্ষক কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা শিক্ষা কার্যক্রম দীর্ঘদিন বন্ধ আছে- এ কথা শুনতে হবে না। তবে যত দ্রুত সম্ভব সরাসরি শিক্ষাদান শুরু করতে হবে। কারণ অনলাইনে ক্লাস এবং মূল্যায়ন সঠিকভাবে করা সম্ভব নয়। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সবাইকে টিকা প্রদান করে দেশে শিক্ষার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় সব পক্ষ দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির সম্মুখীন হবে।