- চতুরঙ্গ
- তিনি বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়প্রত্যয়ী সহযোদ্ধা
বঙ্গমাতার ৯১তম জন্মবার্ষিকী
তিনি বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়প্রত্যয়ী সহযোদ্ধা
বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯১তম জন্মবার্ষিকীবঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯১তম জন্মবার্ষিকী
Posted by Samakal on Saturday, August 7, 2021
যুগে যুগে নারী তার জ্ঞান, ধৈর্য ও শক্তি দিয়ে নানাভাবে পরিবার ও সমাজকে পরিচর্যা করেছেন। বিশেষ করে বাঙালি নারীদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যারা এগিয়ে দিয়েছেন সমাজের স্রোত। তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ বেশি সক্রিয়-আলোকিত এবং তারা আরও জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। কালের ধারাবাহিকতায় সময়ের বাঁকে বাঁকে ইতিহাসে অক্ষয় অধ্যায় হয়ে থাকা তারা আমাদের কাছে নমস্য। আজ এই ধারাবাহিকতায় স্মরণ করি একজন অসাধারণ প্রজ্ঞাবান, মমতাময়ী মা, সংগ্রামী জীবনের আরেক সংগ্রামী মানুষ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে। রক্তস্নাত বাংলাদেশ ও তারও আগের অধ্যায়ে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তিনি অসীম একজন সাহসী, যার দুর্বার সাহস ও প্রজ্ঞা ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে দিয়েছে দূরদর্শী বার্তা।
সময় মানুষকে প্রয়োজনের নিরিখে গড়ে তোলে, নির্ণয় করে; ইতিহাসে স্থান নির্ধারণ করে দেয়। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব লিঙ্গ সমতার ইতিহাসে অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের মানুষ। কথাটি এ জন্য বললাম, আমরা স্পষ্টত দেখতে পাই, তিনি ব্যক্তিজীবন থেকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দাঁড়িয়ে লিঙ্গ সমতার একটা বলয় তৈরি করেছিলেন এবং তার স্বামী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জীবন জড়িয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। গভীর পর্যালোচনায় আরও দেখি, এ দু'জন মানুষ যাদের কাছে আমাদের ঋণ অশেষ ও অপরিশোধ্য, তারা তাদের পরিশীলিত জীবনের নানাসূত্রে কোথাও লিঙ্গ আধিপত্যের জায়গা তৈরি হতে দেননি। এই অধ্যায় একদিকে যেমন স্বর্ণোজ্জ্বল, অন্যদিকে এ ভূখণ্ডের জনজীবনে এক দিগন্ত বিস্তৃত উদ্ভাসন। লিঙ্গ সমতার স্বর্ণালি আলোয় ঝরেছে টুঙ্গিপাড়ার ঐতিহাসিক বাড়ির প্রাঙ্গণে অজস্র শিউলি ফুল।
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ অধ্যায়ের পর অধ্যায় করা যায়। তিনি যেন একজন সর্বংসহা নারী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবন অধ্যায়ে আন্দোলন-সংগ্রামের দৃঢ়প্রত্যয়ী সহযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জীবন জড়িয়ে দ্বৈত জীবনের বাঁকে বাঁকে তাকে দেখা যায় বহুবিধ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন অধ্যায়ে তার মা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রেরণার কথা, মনোবল চাঙ্গা রাখার কথা, সব বিষয়ে শক্তি জোগানোর কথা লিখেছেন। আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' কিংবা 'কারাগারের রোজনামচা' পাঠ করি, তখনও দেখতে পাই এই মহীয়সী নারী বঙ্গবন্ধু ও তার পারিবারিক-রাজনৈতিক জীবনে কতটা অনন্য ভূমিকা পালন করে সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
বাঙালির জাগরণের দলিল 'কারাগারের রোজনামচা' গ্রন্থে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব অর্থাৎ রেণু সম্পর্কে লিখেছেন- 'আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় একজন আইবি কর্মচারী বসে থাকত, আর জেলের পক্ষ থেকেও একজন ডেপুটি জেলার উপস্থিত থাকতেন।... স্ত্রীর সাথে স্বামীর অনেক কথা থাকে কিন্তু বলার উপায় নেই। আমার মাঝে মাঝে মনে হত স্ত্রীকে নিষেধ করে দেই যাতে সে না আসে। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত আমার স্ত্রীকে নিষেধ করে দিয়েছিলাম ঢাকা আসতে। কারণ ও তখন দুইটা ছেলে মেয়ে নিয়ে দেশের বাড়িতে থাকত।' ওই গ্রন্থে তিনি আরও লিখেছেন, 'কারাগারে সাক্ষাৎ করতে যারা যায় নাই, তারা বুঝতে পারে না সেটা কি বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক। ভুক্তভোগীরা কিছু বুঝতে পারে।... এই সাক্ষাৎকে প্রহসনও বলা চলে।'
জীবনের বড় অংশই কারাগারে কাটাতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর বন্দি হিসেবে নেওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। তখন ঢাকায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সামরিক বাহিনীর প্রহরায় গৃহবন্দি অবস্থায় ছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। জীবনে এ রকম অনেক দুঃসহ সময় তাকে পার করতে হয়েছে। এ অবস্থায়ও তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণা ও শক্তি জুগিয়েছেন কঠিন মনোবল নিয়ে।
'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' ও 'কারাগারের রোজনামচা' এ দুটি অমূল্য গ্রন্থে স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নানা রকম স্মৃতিচারণ রয়েছে। ১৯৪৯ সালে জেলখানায় থাকাকালের একটি বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- 'রেণু তখন হাছিনাকে নিয়ে বাড়িতেই থাকে। ও তখন একটু হাঁটতে শিখেছে।... রেণু জানতো আমি সিগারেট খাই। টাকা পয়সা নাও থাকতে পারে। টাকার দরকার হলে লিখতে বলেছিল।' তিনি আরও লিখেছেন- কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাবার কাছ থেকে টাকা পাওয়ার পাশাপাশি স্ত্রী রেণুর কাছ থেকেও টাকা পেতেন। তার আত্মজীবনীতে আরও লিখেছেন, '...সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত, বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনোদিন আপত্তি করে নাই। নিজে মোটেও খরচ করত না। আমার জন্যই রাখত।'
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব যিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে রেণু, তিনি কতভাবেই না সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন সংগ্রামের ইতিহাসে উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছেন! তার উৎসাহ ও অনুরোধেই আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা লিখেছেন- এ তথ্য উঠে এসেছে জাতির পিতার লেখনীতেই। বাঙালি অনেক স্ত্রীই তাদের স্বামীর জীবনে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ভূমিকা বঙ্গবন্ধুর জীবনে ছিল আরও ব্যাপক ও অনন্য। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপ্যাধায় তার 'আনন্দমঠ'-এর প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় তো লিখেছেনই- 'বাঙালীর স্ত্রী অনেক অবস্থাতেই বাঙালির প্রধান সহায়।' বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুর জীবনে কতটা সহায় হয়েছিলেন- এ কথা বঙ্গবন্ধুই লিখে গেছেন।
ইতিহাস সচেতন মানুষ ও সংগ্রামী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদান বঙ্গবন্ধুর জীবনে কতটা ব্যাপৃত, তা সচেতন মানুষমাত্রেই জানা। বঙ্গবন্ধুর লেখায়ই আমরা পাই। তিনি তার স্মৃতিচারণায় বলেছেন, 'আমার জীবনেও আমি দেখেছি যে, গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনোদিন আমার স্ত্রী বাধা দেয় নাই। এমনও দেখেছি যে, অনেকবার আমার জীবনের ১০-১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনো দিন মুখ কালা কিংবা আমার ওপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। অনেক সময় দেখেছি যে, আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি এক আনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলে-মেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে।'
স্পষ্টত বলতে পারি, স্বামীর আধিপত্যের জায়গা থেকে এই পরিবারের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয়নি। দু'জনেই বোধ ও চেতনার জায়গা থেকে একজন খনা, একজন মদনমোহন তর্কালংকার হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, লিঙ্গ সমতার তাত্ত্বিক ধারণার ঊর্ধ্বে উঠে তারা সময়ের পরিপ্রেক্ষিত বুঝেছিলেন এবং কীভাবে জীবনকে মানসম্পন্ন করে নারী-পুরুষের মর্যাদার জায়গা তৈরি করা যায় তাও দেখিয়ে গেছেন।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের আন্দোলন-সংগ্রামের বিস্তৃত অধ্যায়ে, তার রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে ব্যক্তিসম্পর্কের ঊর্ধ্বে উঠে রাজনীতির প্রসঙ্গটি বঙ্গমাতা নিজের জ্ঞানের স্রোতের সমান্তরালে রেখেছিলেন। এই অধ্যায়গুলো পর্যালোচনায় সচেতন যে কোনো মানুষের পক্ষে খুব সহজে বুঝে নেওয়া সম্ভব, বঙ্গমাতা কতটা ইতিহাস-সংলগ্ন ত্যাগী মানুষ ও মানবচেতনার কতটা বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর! একই সঙ্গে গণমানুষের পক্ষের শক্তিও। নিঃসন্দেহে তিনি ইতিহাসের প্রেক্ষাপটকে একেবারে নিখুঁত অনুধাবনে নিজের করতলে বিস্তৃত রেখেছিলেন। আমি স্পষ্টত মনে করি, তিনি লিঙ্গ সমতার আলোকে রাজনীতির বিষয়গুলো ধৈর্যের সঙ্গে দূরদর্শিতার সাক্ষ্য রেখে মোকাবিলা করেছেন। এখানেই তিনি অনন্য। এ জন্যই তিনি অনুসরণীয়। এ জন্যই তিনি ইতিহাসের অক্ষয় অধ্যায়।
'আগস্টের একরাত' উপন্যাসটি লিখতে শুরু করি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পৈশাচিক-বর্বরোচিত ঘটনাবলি অবলম্বন করে। এ উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে কতবার যে স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলাম, এর হিসাব আমার পক্ষে মেলানো ভার। ২০০৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর একটি অনুষ্ঠানে আমার দেখা হয়েছিল তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সঙ্গে। অনুষ্ঠানে আমি আর আনোয়ার (আমার স্বামী) এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। মাহবুবে আলম কাছে এসে আমাকে বললেন, 'আপনার কাছে আমার একটি অনুরোধ আছে। একটি উপন্যাস লেখার জন্য কিছু উপাদান আমি আপনাকে দিতে চাই। আপনি সময় করে হাইকোর্টে আমার অফিসে আসবেন।' কিছুদিন পর তার অফিসে যাই। একটি ফাইল দিয়ে তিনি বললেন, 'এই ফাইলটি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের জবানবন্দি। সেই রাতে কী ঘটেছিল এই বিবরণ পাবেন।' পুরো ফাইলটি পড়তে সময় লাগে; চোখ জলে ভরে যায়। এক পর্যায়ে শুরু করি লেখার কাজ। সংগত কারণেই এ উপন্যাসে বঙ্গমাতা উঠে এসেছেন অনেকের সঙ্গে অন্যভাবে।
১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণকারী ফজিলাতুন্নেছা রেণু পর্যায়ক্রমে কীভাবে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হয়ে ওঠেন- তা ইতিহাস সচেতন মানুষমাত্রেই জানা। অল্প বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ফজিলাতুন্নেছা রেণু বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার পর থেকে নিবেদিত জননেতা স্বামীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সহযাত্রী-সহকর্মী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব দু'হাতে সব সামলেছেন। পারিবারিক জীবনে সুখ-দুঃখের ভাগীদার এই মহীয়সী বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গী; বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আদর্শের প্রতীক। বঙ্গবন্ধু তার পরিবারকে সময় দিতে পারেননি। কারাগার আর রাজনীতির মাঠে কেটেছে তার জীবন। কিন্তু বঙ্গমাতা দৃঢ়চেতা থেকে সব সামলেছেন; এগিয়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু এক ভাষণে বলেছিলেন, 'যে নারী তার স্বামীকে এগিয়ে দেয় নাই, সে স্বামী জীবনে বড় হতে পারে নাই।' বঙ্গবন্ধুর তাৎপর্যপূর্ণ এ কথার একজন স্মারক বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। গভীর শ্রদ্ধায় তাকে স্মরণ করি।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
মন্তব্য করুন