সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার মহান স্থপতি রাজনীতির প্রাণপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থান এবং বিশ্ব রাজনীতিতে অমরত্ব লাভের পেছনে প্রাণশক্তি হয়ে যে মানুষটি কাজ করেছেন তিনি বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। জীবনের প্রতিটি ধাপে, আন্দোলনে, জীবনযুদ্ধে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামসহ সব ক্ষেত্রে প্রেরণাদায়ী এই মহীয়সী নারী আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন। তিনি ইতিহাসের মোক্ষম সময়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রণয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। ফজিলাতুন নেছা মুজিব তার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা সম্মোহনী শক্তি, উদার মানসিকতা, আতিথেয়তা এবং নির্মোহ যাপিত জীবনের কারণে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু আন্দোলন সংগ্রামে ঘুরে বেরিয়েছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। জীবনের একটি বৃহৎ অংশ তিনি কাটিয়েছেন জেলখানায়। এরূপ পরিস্থিতিতে একদিকে তিনি সংসারের দায়িত্ব পালন করেছেন, স্বামীর মামলার খোঁজখবর নিয়েছেন, নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নিয়েছেন, তাদের সংগঠিত করেছেন– সর্বোপরি রাজনীতির গতি প্রকৃতির ওপরও নজর রেখেছেন। এদেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ত্যাগ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণাময়ী মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন তার প্রিয় স্ত্রীর অবদানের কথা, যিনি রেণু থেকে হয়েছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। এ আত্মজীবনীও বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অনুপ্রেরণা ও জোর তাগিদের কারণে। বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনী না লিখলে পাকিস্তান সৃষ্টি এবং এদেশের মুক্তির সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক কিছুই বাঙালির অজানা থাকত।

আজ ৮ আগস্ট এই মহীয়সী সংগ্রামী নারী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মদিন।

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব সুখের ছিল না। মাত্র ৩ বছর বয়সে তিনি পিতা শেখ জহরুল হক এবং ৫ বছর বয়সে মা হোসনে আরা বেগমকে হারান। তার মা-বাবা মারা যাওয়ার পর তাদের দায়িত্ব নেন দাদা শেখ মো. আবুল কাসেমে। শেখ মো. আবুল কাসেম ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমানের চাচা। তিনি শেখ লুৎফুর রহমানকে বললেন, তোর বড় ছেলের সঙ্গে আমার নাতনির বিয়ে দিতে হবে। মুরব্বির হুকুম মানার জন্য বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয়। রেণুর ৭ বছর বয়সে তার দাদাও মারা যান। ফজিলাতুন নেছা মুজিব (রেণু) শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারে চলে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর মাতা সায়েরা খাতুনের তত্ত্বাবধানে অন্যদের সঙ্গে বড় হন। তিনি নিজের বাবা-মা হিসেবেই শেখ লুৎফুর রহমান ও সায়েরা খাতুনকে জানতেন। মুজিব পরিবারের পারিবারিক শিক্ষায় বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। শত বিপদ আপদেও সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি সর্বদা সচেতন ও অনুরাগী ছিলেন। ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন মনে-প্রাণে একজন আদর্শ নারী। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এই মহীয়সী নারী যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারতেন। জীবনে তার কোনো চাহিদা ছিল না। স্মরণশক্তি ছিল প্রখর। অত্যন্ত দানশীল ছিলেন। ৬ দফা আন্দোলনের সময় নিজের অলঙ্কার বিক্রি করে নেতাকর্মীদের আর্থিক সঙ্কটে সহায়তা প্রদান করেছেন। বঙ্গমাতা ছিলেন জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, দায়িত্ববান এবং ধৈর্যশীল মানবিক মানুষ।

মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং ৭ মার্চের ভাষণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও সুচিন্তিত পরামর্শ দিয়ে এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ও সংগ্রামে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মূল আসামি করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলা করে। এ মামলার কারণে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে, তার মুক্তির দাবিতে উত্তাল হয় রাজপথসহ বাংলার পথ-প্রান্তর। আন্দোলনের তীব্রতায় পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব দেয়। আন্দোলনের তীব্রতা ও গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করে ফজিলাতুন নেছা মুজিব কারাগারে সাক্ষাৎ করে, বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লাহোরে বৈঠকে যেতে নিষেধ করেন। তার পরামর্শে শেখ মুজিব প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাবে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। পরবর্তী সময়ে এ আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নিলে ১৯৬৯ সালের ২২ মে শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন। ২৩ মে ঐতিহাসিক জনসভায় বাঙালি তাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে বরণ করে। প্যারোলে মুক্তি না নেওয়ার বিষয়ে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের এই সিদ্ধান্ত যেকোনো মাপকাঠিতে অনন্য হিসেবে স্বীকৃত থাকবে চিরকাল। বঙ্গমাতার অপর সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ হচ্ছে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ সংশ্লিষ্ট।

১৯৭১ সালের মার্চ থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। ভুট্টোর প্রবল বিরোধিতার মুখে ১ মার্চের ঘোষণায় ঢাকায় ৩ মার্চের নির্ধারিত গণপরিষদ অধিবেশন স্থগিত করে দেওয়ায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাংলার আপামর জনগণ। ২ মার্চ হরতাল পালিত হয়। ৩ মার্চের পল্টনের জনসভায় লাখ লাখ জনতার সমর্থনে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এ আন্দোলন কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভার ঘোষণা দিলেন বঙ্গবন্ধু। ৭ মার্চের ভাষণের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে যখন একান্ত নেতাকর্মীরা নানা পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন তখন বঙ্গমাতা এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে যা মন থেকে বলতে ইচ্ছে করে এবং যা বলা উচিত তাই বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহস জুগিয়েছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন যথার্থ সহধর্মিণী হিসেবে। অসমাপ্ত আত্মজীবনী লেখার পেছনে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অবদানের কথা সম্পূর্ণভাবে বইয়ের প্রথমেই তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধু। ফজিলাতুন নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুকে জেলগেটে দেখা করার সময় শুধু বই লেখার পরমর্শ দেননি, তিনি একাধিকবার তাগিদসহ খাতা কলমও কিনে দিয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু জেলে থাকার সময়ে পরম স্নেহে তার ছেলেমেয়েদের লালন-পালন, শিক্ষা প্রদান করতেন এবং হয়ে উঠেছিলেন প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মীর নিকট কখনও মমতাময়ী মা, বড় বোন এবং পরম নিরাপদের আশ্রয়স্থল। তিনি জীবনের অনিশ্চয়তা এবং ক্রমাগত বাসা বদলের ঝামেলায় অনেক কষ্টে ঐতিহাসিক ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের ৬৬৭ বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

১৯৬১ সালের অক্টোবরে বাড়িতে ওঠেন এবং ১৯৬৪ সালে গৃহনির্মাণ সংস্থা থেকে ৩২ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করে বাড়ি নির্মাণ করেন। রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর সাহস ও পরামর্শ প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অসীম সাহস ও ধৈর্য নিয়ে সংসারের হালধরা এক মমতাময়ী নারী।

বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবন থেকে আমৃত্যু এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ে এবং মুক্তিসংগ্রামে জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুকে সব সময় উৎসাহিত করেছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। ফজিলাতুন নেছা মুজিব কখনও ভেঙে পড়েননি। তিনি অসীম সাহসী বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবিচল আস্থা নিয়ে তার স্বভাবজাত মানবিক গুণাবলি নিয়ে সবাইকে আপন করে নিয়েছেন। নিজের জীবনের কোনো চাহিদার প্রতি লক্ষ্য না রেখে তিনি বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের পাশে নিজের যোগ্যতায় আপন আলোয় উদ্ভাসিত ছিলেন। এদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন আমৃত্যু এই মহীয়সী নারী। আজ ৮ আগস্ট বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণাদায়ী এই মহীয়সী বীর নারী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মদিনে জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন।