- চতুরঙ্গ
- নতুন দিনের যুবলীগ
নতুন দিনের যুবলীগ

অগনিত যুবকের প্রাণের সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক যুব কনভেনশনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে সংগঠনটি। গত চার দশকের বেশি সময় দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম এবং হাজারো নেতাকর্মীর আত্মত্যাগের মাধ্যমে যুবলীগ বৃহৎ যুব সংগঠনে পরিণত হয়েছে।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু একদিন তার স্নেহের ভাগ্নে এবং ঘনিষ্ঠ শিষ্য শেখ ফজলুল হক মনিকে বলেন, 'ছাত্রজীবন পেরিয়েছে, অথচ যৌবন পেরোয়নি এরকম বহু যুবক এখন আদর্শহীন, লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। অথচ এখন লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নানা উচ্ছৃঙ্খল কাজে জড়িত হচ্ছে। এদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে দেশ ও জাতি গঠনের কাজে লাগাতে পারলে একটি যুবশক্তি তৈরি হবে, যে শক্তির ভেতর থেকে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে। দেশ ও সমাজের ভবিষ্যতের রূপকার হবে এই যুবসমাজ।' এই সূত্র ধরে পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুব সমাজকে সংগঠিত করতেই শেখ ফজলুল হক মনি গড়ে তোলেন যুবলীগ। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সংগঠনটি একটি শক্তিশালী যুব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শেখ মনি নিজেই। বহুমাত্রিক প্রতিভাবান শেখ মনি কেবল রাজনীতি নয়, সাহিত্য এবং সাংবাদিকতায়ও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার লেখা 'অবাঞ্ছিতা' উপন্যাস পাঠক সমাদৃত। এছাড়া তিনি দৈনিক বাংলার বাণী, ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস ও বিনোদন ম্যাগাজিন 'সিনেমা'র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই মনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ষাটের দশকে সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি সাহসী নেতৃত্ব দেন। ১৯৬০-১৯৬৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।
১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ছয় মাস কারাভোগ করেন। ১৯৬৪ সালের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আবদুল মোনেম খানের কাছ থেকে সনদ নিতে তিনি অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তী সময়ে তিনি মামলায় জিতে ডিগ্রি ফিরে পান। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়ে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয় এবং তিনি কারারুদ্ধ হন। দেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের জন্য গোটা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা রাখেন শেখ ফজলুল হক মনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে শেখ মনি ও তার সহধর্মিণী শেখ আরজু মনিকেই সর্বপ্রথম হত্যা করা হয়। বড় ছেলে পরশের বয়স তখন ৫ বছর আর ছোট ছেলে তাপস ৪ বছরের শিশু। বাবা-মা হত্যাকাণ্ডের পর দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয়েছে দুই ভাইকে। কখনও আত্মীয়দের বাসায় লুকিয়ে থাকতে হয়েছে, আবার কখনও পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। এভাবে দুই বছর কাটার পর শেখ আছিয়া বেগমের সঙ্গে ১৯৭৮ সালে তারা চলে যান ভারতে। চাচা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ ফজলুর রহমান মারুফ, ফুফু শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন বিদেশে শরণার্থী। পরশ ধানমন্ডি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে দ্বিতীয়বার এমএ ডিগ্রি লাভ করেন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে। দেশে ফিরে তিনি দীর্ঘদিন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন। বর্তমানে তিনি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করছেন।
টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। যে কারণে ক্ষমতাসীন সংগঠনের সহযোগী সংগঠন হিসেবে যুবলীগের সাংগঠনিক পরিচয়ে কেউ কেউ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। সংগঠনের ঢাকা মহানগর কমিটি থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতৃত্ব অনেকের বিরুদ্ধে ক্লাব পরিচালনার আড়ালে অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো ব্যবসার অভিযোগ ওঠে। এমন অভিযোগে সংগঠনের প্রভাবশালী নেতাদের কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হন। কেউ কেউ টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির অভিযোগে বহিস্কারও হন। সব মিলিয়ে ভাবমূর্তির সংকটে পড়ে এই সংগঠনটি। ২০১৯ সালের ২৩ নভেম্বর যুবলীগের সপ্তম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। যুবলীগের কংগ্রেসে চেয়ারম্যান হিসেবে হাল ধরেন অধ্যাপক শেখ ফজলে শামস পরশ। পরশের 'রানিং মেট' তথা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তৃণমূলের নেতৃত্ব থেকে গড়ে ওঠা মাইনুল হোসেন খান নিখিল।
যুবলীগের শীর্ষ দুই পদের নেতৃত্ব সমন্বয়ে কেবল ভাবমূর্তিতে স্বচ্ছ নয়, রাজপথের নির্ভীক ও সাহসী নেতৃত্বের বিষয়টিও মাথায় রেখে নেতৃত্ব উপহার দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দায়িত্ব গ্রহণের পর পরশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল যুবলীগের অতীত গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করা, যুবলীগের প্রতি যুবসমাজ তথা আপামর জনসাধারণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং যুবলীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সমুন্নত করা। এসকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি সুদৃঢ় ও স্পষ্ট অবস্থান নেন। এরইমধ্যে বৈশ্বিক মহামারি করোনার ঢেউ আঘাত হানে বাংলাদেশে। সেই সঙ্গে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়। এসকল সংকটজনক পরিস্থিতিতে যুবলীগ তার মানবিক ভাবমূর্তি দেশব্যাপী সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত করে। জাতীয় সংসদে যার ভূয়সী প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
যুবলীগ দেশব্যাপী স্বাস্থ্যবিধি প্রচারের পাশাপাশি মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান বিতরণ করে। সরাসরি ৪৩ লাখ মানুষকে খাদ্য সহায়তা দান করে। ট্রাক, রিকশা ভ্যানে করে বস্তিবাসীকে খাবার পৌঁছে দেয়। ঢাকা মহানগর ও বিভিন্ন জেলা, উপজেলা পর্যায়ে ২৪ ঘণ্টা ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ও ২৪ ঘণ্টা টেলিমেডিসিন সার্ভিস প্রদান করে। চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করে। শ্রমিক সংকটে কৃষকের ধান কেটে সহায়তা করে যুবলীগ। রমজান মাসে ইফতার ও রান্না করা খাবার বিতরণ করে। মুজিব শতবার্ষিকী উপলক্ষে দেশব্যাপী বৃক্ষ রোপণ করে যুবলীগ।
ভাবমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অযোগ্য এবং বিতর্কিতদের সংগঠন থেকে সরিয়ে শিক্ষিত, মেধাবী, ত্যাগী, যোগ্য ও পরিচ্ছন্ন যুবকদের নেতৃত্বে নিয়ে আসা। এই চ্যালেঞ্জও অত্যন্ত দক্ষতায় উৎরে যান শেখ পরশ। এক বছর যাচাই-বাছাইয়ের পরে সকল শ্রেণি ও পেশার মধ্য থেকে ২০১ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাহী কমিটি ও ২০০ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেন। তরুণ আইনপ্রণেতা, আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, সংস্কৃতিকর্মী ও সাবেক ছাত্রনেতাদের সমন্বয়ে গঠিত যুগোপযোগী এ কমিটি সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। এ কমিটির মাধ্যমে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানো একঝাঁক যুবক খুঁজে পেয়েছে আলোর শিখা; কালিমা মুক্ত রাজনীতির মসৃণ পথ। আর শেখ পরশ হয়ে উঠেছেন নতুন স্বপ্নের দূত।
মন্তব্য করুন