রফিকুল ইসলাম। ভাষাসংগ্রামী রফিকুল ইসলাম। জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। দীর্ঘ ৫০ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম। আমাদের সংস্কৃতির, আমাদের সাহিত্যের, আমাদের জাতিসত্তার অনন্য এক ঠিকানা রফিকুল ইসলাম। আজ এই বিপন্ন মুহূর্তে স্যারকে নিয়ে কিছু লিখতে আমার কলম চলছে না। গত ১৯ নভেম্বর যার কাছে লেখার জন্য ফোনে অনুরোধ করেছি, খানিকটা কথা বলেছি- সেই স্যারকে নিয়ে 'স্মরণ' লিখতে আমার কলম থেমে যায়। তবুও এটা অমোঘ সত্য, স্যার আর নেই আমাদের সঙ্গে- কিংবা আছেন আরও গভীরভাবে পরোক্ষভাবে আমাদের প্রতিদিনের সংগ্রামে।
রফিকুল ইসলামের বহুমাত্রিক কৃতির মধ্যে প্রথমেই মনে আসে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তার প্রত্যক্ষ সংশ্নিষ্টতার কথা। ক্যামেরা নিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত দিনে তিনি যেসব ছবি তুলেছেন- তা এখন আমাদের গৌরবের অংশ। কেবল আমাদের বলি কেন, তা তো আজ বিশ্বমানবেরই গৌরবের উৎস। এখন যত ছবি আছে রাষ্ট্রভাষা-বিষয়ক, তার প্রায় ৭০ ভাগ ছবিই রফিকুল ইসলামের ক্যামেরায় তোলা। বাঙালির গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রফিকুল ইসলাম ছিলেন প্রথম সারির সৈনিক। এসব ভূমিকার কারণে ১৯৭১ সালের ১৩ আগস্ট তাকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী গ্রেপ্তার করে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে নির্মম অত্যাচার করে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে তিনি মুক্তিলাভ করেন। উত্তরকালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে রফিকুল ইসলাম একাধিক বই রচনা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ৫০ বছর শিক্ষকতার পেশায় জড়িত ছিলেন রফিকুল ইসলাম। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি দীর্ঘকাল ছিলেন নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। ছিলেন, আমৃত্যু বাংলা একাডেমির সভাপতি। জাতির ক্রান্তিকালে রফিকুল ইসলাম সবসময় সামনে থেকে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগকে স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে গড়ে তুলতে তিনি পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
নজরুল-বিশেষজ্ঞ হিসেবে রফিকুল ইসলামের খ্যাতি উভয় বাংলায় সমধিক পরিচিত। কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে রফিকুল ইসলামের গবেষণা সঞ্চার করেছে অনন্য মাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নজরুলকে সমাধিস্থ করার ক্ষেত্রেও তার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নজরুল অধ্যাপক; ছিলেন নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক। তার তত্ত্বাবধানে নজরুল বিষয়ে গবেষণা করে ১০ জন গবেষক এম.ফিল./পিএইচডি গবেষণা করে উপাধি পেয়েছেন। নজরুলের গানের স্বরলিপি বিন্যাসেও তার ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়। কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়াও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষাতত্ত্ব, বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ- এসব বিষয়ে তার গ্রন্থ পণ্ডিতসমাজে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত 'বাংলা ব্যাকরণ' গ্রন্থ রচনায় তিনি পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তার অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়।
রফিকুল ইসলাম ছিলেন ব্যতিক্রমী এক সংগঠক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদযাপন, বাংলা অ্যালামনাইর অনুষ্ঠান- এসব ক্ষেত্রে তার সাংগঠনিক দক্ষতা আমাদের বিশেষভাবে নজর কেড়েছে। বাংলা বিভাগের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল কিংবদন্তিপ্রতিম। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত 'জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি'র সভাপতি হিসেবে তিনি পালন করে গেছেন ঐতিহাসিক দায়িত্ব।
আলোকিত মানুষ রফিকুল ইসলাম আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আছে তার কর্ম, তার সংগ্রামী জীবনকথা; আছে তার অমূল্য গ্রন্থরাজি। রফিকুল ইসলামের জীবনদর্শন ও সংগ্রামের পথ ধরে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে শামিল হওয়াই হবে তার প্রতি সম্মান দেখানোর শ্রেষ্ঠ উপায়। যেখানেই থাকবেন, ভালো থাকবেন আমাদের প্রিয় স্যার।

লেখক :প্রাবন্ধিক, প্রাক্তন উপাচার্য, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়