দুঃখিত, আমরা রাজনীতিবিদদের দায়ী করছি। দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অন্তত ২৬ জন ছাত্রের পরিবারে, মা-বাবা-ভাই-বোন-চাচা-মামা-খালা-ফুপু আরও কত নিকটাত্মীয় কত শত জনের অন্তরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে; ওই গৃহগুলো কান্নায়, হাহাকারের দীর্ঘশ্বাসে বাষ্পায়িত হয়ে আছে; অনেক গৃহ আলো না জ্বালিয়ে অন্ধকারে ডুবে আছে- আমরা কি সবাই সমানভাবে উপলব্ধি করছি? অবশ্যই অগণিত মানুষ তা করছেন। কারণ আমরা জানি, সব ছাত্রই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না; মেধাবীরাই পারে। এতজন মেধাবী ছাত্র প্রকৌশলী হতে পারল না; জীবনের মাঝপথে হারিয়ে গেল! এ তো শুধু অনেক পরিবারের স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাওয়া নয়। অনেক অর্থমূল্য দিয়ে মানবসম্পদ তৈরির পথে বিঘ্ন- এ যে দেশ ও সমাজের বিরাট ক্ষতি। কে বা কারা দায়ী?

বুধবার দ্বিপ্রহরে ঢাকা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের একটিতে বিচারক আবু জাফর মোহাম্মদ কামরুজ্জামান রায় পড়লেন। প্রায় তখনই টেলিভিশনের খবরে আমরা জানলাম- ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা ছাত্রাবাসে গভীর রাতে আবরার ফাহাদ নামে তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রকে যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, সেই অপরাধে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে। আবরার ও এই ২৫ জনকে নিয়ে ২৬ জন তাজা তরুণ। আবরার মারা গেছেন। মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হতে উচ্চ আদালতের অভিমত লাগবে; কেউ কেউ হয়তো রেহাই পেতে পারেন। তবে তারা যে সবাই প্রকৌশলী হতে পারলেন না; জীবন হয় অবসান, না-হয় বিপর্যস্ত হয়ে গেল- এটা সত্য। দায়ী কে বা কারা?

আবরারের দুঃখী পিতা-মাতা বাকি পাঁচজনেরও ফাঁসি হলে খুশি হতেন; রাষ্ট্রপক্ষ ও বুয়েটের শিক্ষক-ছাত্রগণ রায়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন। তারা রায় দ্রুত কার্যকর দেখতে চান- এমন প্রতিক্রিয়া সংবাদমাধ্যমে দেখেছি। ক্ষতিগ্রস্তদের আবেগ বোধগম্য। তবে ২৫ জন তরুণকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়ার রায় অনেক বড় তাৎপর্য বহন করে। তার মানে এই নয় যে, অপরাধীদের শাস্তির গুরুত্ব কম বা শাস্তি লঘু হোক। এই ২৫ জনই প্রাপ্তবয়স্ক। অপরাধের শাস্তি তাদের প্রাপ্য। যথাযথ প্রমাণ হাজির করলে বিচারক শাস্তি না দিয়ে পারেন না। তবে আমরা সেই মহাজনবাক্যও ভুলতে পারব না- 'দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে, সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।' এই দণ্ড দিয়ে হয়তো বিচারকও কাঁদছেন। বিচার সঠিক হয়েছে মেনে নিয়ে আমরা সমাজও কাঁদছি। কাঁদতে হয়, কারণ আমরা জানি, পাপকে ঘৃণা করতে হয়, পাপীকে নয়। কোনো মানবশিশু পাপী হয়ে জন্মায় না। এই ২৫ তরুণ সব সময় পাপী ছিলেন না। পিতা-মাতা তাদের শিক্ষালয়ে পাঠিয়েছেন লেখাপড়া শিখতে; অপরাধী হতে নয়। বুয়েট বা অন্য যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের অপরাধী বানায় না।

ব্যক্তিগতভাবে উচ্চশিক্ষিত দু-চারজন অপরাধী হতে পারে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে দল বেঁধে অপরাধী হওয়ার এমন নজির তো আমাদের দেশে কয়েক দশক আগে ছিল না। গত ৩০-৪০ বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা জানি, সব ছাত্র নয়, তবে অনেকের জন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বড় একটি 'শিক্ষালয়' হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল; বিশেষত যেসব দল ক্ষমতায় থেকে দেশ শাসন করেছে, করবে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রবল খবরদারিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনও যে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিয়ে চালানো যায় না- তা কি অজানা? উপাচার্য নিয়োগ কীভাবে হয়, তা থেকে শুরু করে ছাত্রাবাসের ডাইনিং হলের ম্যানেজার নির্ধারণ পর্যন্ত কী হ্যাপা, তা কার অজানা আছে?

ডাইনিং হল ম্যানেজার কেলেঙ্কারিতেই সবেমাত্র ৩০ নভেম্বর খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষক ড. মোহাম্মদ সেলিম হোসেনের হূৎপিণ্ডের স্পন্দন থেমে গেল বলে সন্দেহ ও তদন্ত ঘুরপাক খাচ্ছে। এজন্য দোষারোপের তীর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দিকে নির্দেশিত। আর আবরার হত্যায় সাজাপ্রাপ্ত সবাই বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। ছাত্রলীগ বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভিভাবকত্বে পরিচালিত ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন। যে তিনটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন নিকট-অতীতে দেশে এমন সব ভয়ানক অপরাধমূলক ঘটনা ঘটিয়েছে, সেগুলোর বাকি দুটি হচ্ছে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। ক্ষমতার রাজনৈতিক দলগুলো।

তাই বলছিলাম, সমাজে অপরাধীর উদ্ভব ও অপরাধমূলক কাজে জড়িত হওয়ার অনেক কারণ থাকে। ছাত্রদের এ-ধরনের অপরাধমূলক কাজের জন্য আমরা দুঃখের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে ও প্রধানত ক্ষমতা চর্চাকারী রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের দায়ী করতে পারি। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন মহান ভাষা আন্দোলন থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত জাতির গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ের গৌরব গায়ে মাখা ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন; দেশের ইতিহাসের অনেক আদরের ধন। সাবেক উপনিবেশ ও শিক্ষার হার যেসব দেশে কম সে দেশগুলোতে অপেক্ষাকৃত সচেতন নাগরিক হিসেবে ছাত্ররা এই ভূমিকাই পালন করে। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে, বিশেষত ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতাদের শাসনামলে আর সেই বাস্তবতা নেই।

ক্ষমতা চর্চাকারী রাজনীতিবিদরা ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিজ নিজ দলের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করেছেন। চাঁদাবাজিসহ বহু রকম অপরাধ করার সুযোগকে পরিণত করেছেন ওই লাঠিয়ালদের অঘোষিত বেতন হিসেবে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন বহু বছর বন্ধ রাখা হয়েছে। সেগুলোতেই ছাত্রদের পাঠ-অতিরিক্ত ক্রীড়া-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা হতো এবং চরিত্র ও নেতৃত্ব গঠনের অনুশীলন হতো। এ চর্চা ধ্বংস করার জন্য কারা দায়ী? কেন?

রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে বছরের পর বছর আমরা লিখে চলেছি। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যার আর প্রয়োজন নেই। এখন শিক্ষাঙ্গনে প্রতিনিয়ত হত্যা-সন্ত্রাস, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত সব নির্বাচনে অনিয়ম-সন্ত্রাসে দুর্বৃত্তায়ন ও কলুষিত রাজনীতির চেহারা প্রকট হয়ে উঠেছে। বুয়েটের আবরার হত্যার রায়ে আমি যতখানি ন্যায়বিচার দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি কলুষিত রাজনীতির পরিণাম ও মূল্য কতখানি! রাজনীতিবিদদের কাছেই আমাদের জিজ্ঞাসা ও প্রত্যাশা- এই কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে পরিশীলিত রাজনীতির মাধ্যমে দেশ ও জাতি গড়ার আনন্দ আমরা কীভাবে, কবে পাব? লেখক সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক