ভারতবর্ষে আধুনিক সাংবাদিকতার সূচনা হয়েছিল বাংলা থেকেই। উপমহাদেশে প্রথম মুদ্রণযন্ত্র আমদানি করেন পর্তুগিজরা ১৫৫৭ খ্রিষ্টাব্দে। খ্রিষ্টান মিশনারিদের ধর্মীয় প্রচারপত্র ও শিক্ষাবিষয়ক পুস্তিকা প্রকাশকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে আধুনিক মুদ্রণশিল্পের সূচনা হয়। ইংল্যান্ডে ১৭০২ সালে সর্বপ্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হলেও কোম্পানি সরকার ভারতবর্ষে সংবাদপত্র প্রকাশে আগ্রহী ছিল না। ১৭৭৪ সালে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস-এর কাউন্সিল সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস ভারতবর্ষে আসার পর তার প্রভাবে ভারতবর্ষে সংবাদপত্র প্রকাশের পথ সুগম হয়। তিনি ইংল্যান্ডে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকির 'বেঙ্গল গেজেট' ভারতবর্ষের প্রথম মুদ্রণকৃত সংবাদপত্র। ১৮১৮ সালে মাসিক 'দিগদর্শন' এবং সাপ্তাহিক 'সমাচার দর্পণ' প্রকাশিত হওয়ার পর এ শিল্পে ভারতীয়দের হাতেখড়ি হয়। ভারতবর্ষের প্রথম বাংলা দৈনিক 'সংবাদ প্রভাকর'। এটি অবশ্য ২৮ জানুয়ারি ১৮২৮ সালে সাপ্তাহিক, ১৮৩৬ সালের ১০ আগস্ট 'বারত্রয়িক' এবং ১৪ জুন ১৮৩৯ থেকে দৈনিক রূপে প্রকাশিত হয়। উনিশ বছর বয়সের তরুণ কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এই পত্রিকা প্রকাশ করেন।

সংবাদপত্রগুলো একটি মৌলদর্শন অনুসরণ করেছিল। যেমন হিকির সাপ্তাহিক বেঙ্গল গেজেটে স্লোগান ছিল 'সকলের জন্য উন্মুক্ত কিন্তু কারও দ্বারা প্রভাবিত নয়' (ওপেন টু অল পার্টিস বাট ইনফ্লুয়েন্সড বাই নান)। প্রথম দৈনিক সংবাদ প্রভাকর 'সূর্য-কিরণের ন্যায় সকলের প্রতি সৎ ও সমতার' উদ্দেশ্য নিয়ে (সতাং মনস্তামরসপ্রভাকরঃ সদৈব সর্ব্বেষু সমপ্রভাকরঃ/ উদেতি ভাস্বৎ সকলাপ্রভাকরঃ সদর্থসম্বদনবপ্রভাকর) প্রকাশিত হয়। সেসব সংবাদ-সাময়িকপত্র কোনো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। তবে সংবাদপত্রগুলো এক গভীর ভাবদর্শনের দ্বারা গণমানুষকে প্রভাবিত করতে পেরেছিল। দিগভ্রান্ত ও আত্ম-পরিচয়হীন অধিবাসীদের মানসলোকে আত্মজাগরণের মশাল জ্বেলে দিতে সক্ষম হয়েছিল। স্বদেশি সংবাদপত্র প্রকাশনা শিল্প ভারতে রেনেসাঁর সূচনা করেছিল।

এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেয় বাংলা ও বাঙালি। ওই সময়ে উদারপন্থিদের 'ব্রাহ্মসভা', রক্ষণশীলদের 'ধর্মসভা' এবং 'ডিরোজিয়ান'দের পাশ্চাত্য জীবনদর্শনের ত্রিমুখী বাদানুবাদে অনেক সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সৃষ্টি হওয়া এসকল চিন্তা-দর্শনের প্রভাবে সামাজিক ক্ষেত্রে চলছিল প্রবল আলোড়ন। এর প্রভাব ছিল সূদুরপ্রসারী। মধ্যযুগীয় নিশ্চল এবং অনেকটা বিচ্ছিন্ন ও আত্মকেন্দ্রিক ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা আধুনিক তথ্যপ্রবাহের সুযোগে চলৎশক্তি লাভ করে ঐক্যবদ্ধ একটি সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। মতাদর্শিক ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও এসকল প্রকাশনায় স্বদেশি ভাবনার প্রকাশ ঘটতে থাকে, যা কালক্রমে স্বরাজ কায়েমের অধিবাসীদের মনস্তত্ত্ব গঠন করতে ভূমিকা রাখে।

গুপ্তচরদের মাধ্যমে সংবাদ সংগ্রহ অথবা ঢাক পিটিয়ে বা চোঙা ফুঁকে তথ্য পরিবেশনার প্রাচীন পদ্ধতির ওপর দাঁড়িয়ে আধুনিক সংবাদপত্রের সূচনা হয়। তবে শুরুর দিকে মাসিক, সাপ্তাহিক পাক্ষিক এবং ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে সাময়িকপত্র প্রকাশিত হতো। পত্রিকা বিতরণ ব্যবস্থাও এত সহজ ছিল না। টাটকা খবর পাওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। জনৈক সীতারাম ঘোষাল সংবাদপত্র পেতে বিপত্তি হওয়ায় সম্পাদকের কাছে অভিযোগ করে বলেন, 'শ্রুত হইলাম যে আমার কাগজ প্রতি সপ্তাহে আমাদের গ্রামের পোষ্টআপিসে রবিবারে আসিয়া থাকে, কিন্তু গ্রামের পোষ্টমাষ্টার বাবু আমাকে না বলিয়া আমার কাগজ খুলিয়া দেখেন, মঙ্গলবার প্রাতঃকালে পিয়নকে দেন, কিন্তু ঐ পিয়ন প্রাতঃকালে আমাকে না দিয়া সন্ধ্যার সময় দিয়া থাকেন...'(এডুকেশন গেজেট ৬.২.১২৭৮ বঙ্গাব্দ)। কিছু অভিজাত ব্যক্তি মফস্বল অঞ্চলে পত্রিকা রাখতেন। প্রতিবেশীরা গভীর আগ্রহ সহকারে এসব পত্রিকা ভাগাভাগি করে পড়তেন। আগ্রহী পাঠকরা অপেক্ষায় থাকতেন পত্রিকার জন্য।

বর্তমানকালে আকারে-প্রকরণে-গুণে-মানে পত্রিকার ধরন বদলেছে। সাময়িকপত্র থেকে দৈনিক এমন কি সান্ধ্য দৈনিক পর্যন্ত বের হচ্ছে। এছাড়া দৈনিক পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ ছাড়াও অনলাইন পোর্টালেও সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামাজিকমাধ্যম। প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে আছে অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক মিডিয়া। মফস্বল থেকেও প্রচুর সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। এভাবে সংবাদমাধ্যম এখন প্রকৃত অর্থেই গণমাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে। যে কোনো তথ্য নিমেষেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। অবাধ তথ্যপ্রবাহ তাই দুনিয়াকে বৈশ্বিক গ্রামে রূপান্তর করেছে।

এর সুফল যেমন মানবজাতি ভোগ করছে, আবার অনেক চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। অনেক ভ্রান্ত সংবাদ গুজবে পরিণত হয়ে বড় ধরনের অঘটনেরও জন্ম দিচ্ছে। আগের যুগে গুজব মুখে মুখে সঞ্চারিত হতো বলে নির্দিষ্ট এলাকায় প্রভাব সীমাবদ্ধ থাকত। বর্তমান যুগে প্রযুক্তির কল্যাণে যে কোনো তথ্য রটনাকারীদের উদ্দেশ্যর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে জালিয়াতির মাধ্যমে উপস্থাপন করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সামাজিকমাধ্যমের অপব্যবহারের মাধ্যমে নিমেষেই গণমানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। বিগত একদশকে বিশ্বময় এ ধরনের সামাজিক সংক্রমণের অসংখ্য ঘটনা পৃথিবী লক্ষ্য করেছে। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তি, সমাজ ও দেশকে বড় ধরনের মূল্য দিতে হয়েছে।

বিভিন্ন মতবাদের প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে সংবাদপত্রের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে বটে। অন্যদিকে জোসেফ পুলিৎজারের 'নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড' এবং উইলিয়াম হার্স্টের 'দ্য জার্নালের' কাটতি বৃদ্ধির অশুভ প্রতিযোগিতা এবং ব্যক্তিগত রেষারেষিকে কেন্দ্র করে ঊনবিংশ শতকের শেষ পাদে ইয়োলো জার্নালিজমের জন্ম হয়। তখনকার সময়ের দু'জন সাংবাদিকের বৈরিতার প্রতীক 'হলুদ বালক' বর্তমানকালে অনেক অসৎ সাংবাদিক তথা স্বার্থান্বেষী মালিকের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মাধ্যম হিসেবে 'হলুদ সাংবাদিকতা' এক প্রকার শিল্পে পরিণত হয়েছে।

তবে এ কথাও সত্য, প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিকরা স্ব-আরোপিত স্বায়ত্তশাসন ভোগ করেন। তাই তো মালিক পক্ষের প্রচ্ছন্ন চাপ উপেক্ষা করেও অনেক সংবাদমাধ্যম গণমানুষের মুখপত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। সংবাদপত্রের দু'শ বছরের এই অভিযাত্রায় অনেক প্রতিকূলতাও অতিক্রম করতে হয়েছে। ভারতবর্ষে সংবাদপত্র প্রকাশনা শিল্পের সূচনার কয়েক বছরের মধ্যেই ১৮২৩ সালে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধী 'গ্যাগিং অ্যাক্ট' প্রণীত হয়েছিল।

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরও সংবাদপত্রের ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছিল। ১৯৪৭-পরবর্তী পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিশেষ করে সামরিক শাসকগণ নানাভাবে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করেছে। ১৯৭৫ পরবর্তী সকল সামরিক শাসনামলে সংবাদপত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ভয়ংকর রকমে বেড়ে গিয়েছিল। অলিখিত সেন্সরশিপ আরোপ করা হতো সংবাদপত্রে। তবে নানা বিধিনিষেধের কারণে সংবাদপত্রগুলো মাঝে মধ্যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও এর বিকাশ চলমান রয়েছে।

'বেঙ্গল গেজেট' প্রকাশের পর দু'শ একচল্লিশ বছর অতিবাহিত হয়েছে। সাময়িকপত্রের যুগ অতিক্রম করে অনলাইন দৈনিকের যুগ চলছে। এখন মুহূর্তের মধ্যে যে কোনো তথ্য সংবাদে পরিণত হয়। সাংবাদিকতা এখন গণমাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ভিপি ডাক নয়- ভোরের আলো ফোটার আগেই পত্রিকা হাতে সংবাদকর্মীরা পৌঁছে যান ঘরের দোরগোড়ায়। তারও আগে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ডিভাইসে। এ সত্ত্বেও ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত পত্রিকায় চাহিদা বেড়েই চলেছে। মনে রাখতে হবে ভ্রান্ত তথ্য পরিবেশনকারী প্রচারমাধ্যম তথা হলুদ সাংবাদিকতা মারণাস্ত্রের চেয়েও ভয়ংকর। এ বিষয়ে সকলের সচেতনতা প্রয়োজন।