- চতুরঙ্গ
- দেশপ্রেমের দীক্ষা জরুরি
দেশপ্রেমের দীক্ষা জরুরি

প্রায় দুই বছর হতে চলল করোনা মহামারিতে বিশ্ব নাস্তানাবুদ। তবে আশার কথা, করোনা প্রতিরোধী ভ্যাকসিন এসেছে আরও আগেই। বিশ্বের দেশে দেশে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ চলছে। তাতে মানুষ কিছুটা হলেও নিরাপত্তা এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে। কিন্তু ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরও এখনও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে করোনার নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট চোখ রাঙাচ্ছে। আমরা যে মুহূর্তে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছি তখন যা ঘটে গেল তা সত্যিই দুঃখজনক। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমাদের জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশকে আমরা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করতে পারিনি।
মিরপুরের একাডেমি মাঠে ১৫ ও ১৬ নভেম্বর অনুশীলনস্থলে সফররত পাকিস্তান ক্রিকেট দলের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে বিতর্কিত অনুশীলন করাটাকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি, করাচি কিংবা ইসলামাবাদ নয়, স্বাধীন বাংলার মিরপুর। সেই মিরপুর, একাত্তরে যেখানে নিরীহ বাঙালিদের ওপর গণহত্যায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানি সেনারা। সেই মিরপুরে উড়ল পাকিস্তানের পতাকা, তাও কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই। আইসিসির নিয়মানুসারে কোনো ইভেন্ট কিংবা দ্বিপক্ষীয় সিরিজ চলাকালে দুই দেশের পতাকা উড়তেই পারে। তবে পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের অনুশীলনেই সেটা কেন এককভাবে উড়াতে হলো?
গত ২১ বছর ঘরের মাঠে আইসিসির সব দলকেই আতিথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ। এমন দৃশ্য দেখা যায়নি এর আগে। খুব সচেতনভাবেই পাকিস্তান ক্রিকেট দল তা করেছে এটি পরিস্কার। আরও অবাক এবং বিস্মিত হওয়ার মতো বিষয়, গত ১৯, ২০ ও ২২ নভেম্বর সিরিজের টি-টোয়েন্টি ম্যাচগুলোতে মিরপুরের গ্যালারিতে পাকিস্তানি দর্শকদের পাশাপাশি বাংলাদেশি দর্শকদের হাতেও পাকিস্তানের পতাকা দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের আউট করলে বা পাকিস্তানের কোনো ক্রিকেটার ছক্কা মারলে দর্শকদের উলল্গাস দেখে বোঝার উপায় ছিল না এটা বাংলাদেশের মাঠ নাকি অন্য কোনো দেশের মাঠ।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজম বলেছিলেন, 'বাংলাদেশে আমাদের অনেক সমর্থক আছে।' বাবর আজমের কথাটা প্রমাণ করার জন্যই যেন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে হঠাৎ পাকিস্তানি সমর্থক অনেক বেড়ে গেছে। দ্বিতীয় ম্যাচে পাকিস্তান দলের সেরা পারফরমার ফখর জামান নিজেও অবাক। এত সমর্থন মিরপুরে তারা পাবেন কল্পনাও করতে পারেননি। তাদের এমন সমর্থন দেখে ম্যাচ শেষে বলেই দিলেন, 'সমর্থন দেখে মনে হচ্ছে ভিন্ন কোনো দেশে নয়, পাকিস্তানের মাটিতেই খেলছি। আমাদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা দেখে আমি মুগ্ধ। আমরা সত্যিই খুশি।'
যেভাবেই দেখুন না কেন বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীকালে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর, একাডেমি মাঠে অনুশীলনস্থলে পাকিস্তানি পতাকা ওড়ানো, খেলার মাঠে বাংলাদেশিদের হাতে পাকিস্তানি পতাকা এবং তাদের সমর্থন করে উলল্গাস- এর সবকিছুই এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ বলেই মনে হয়। ধারণা করা যায় সব ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। খেলাধুলার সঙ্গে রাজনীতি মেশানোর কোনো সুযোগ নেই। তবে অতি উদারতা এবং সহজভাবে নেওয়ার পরিণাম ভালো না-ও হতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, খেলাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মাটিতে দেশপ্রেমের অনুভূতিকে ক্ষতবিক্ষত করার মতো এমন ঘটনা কেন ঘটতে দেওয়া হলো, কারা ঘটাল এমন ঘটনা? ধারণা করি, তারাই ঘটিয়েছে এমন ঘটনা যাদের আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছরেও দীক্ষায় দীক্ষিত করতে পারিনি। বিসিবি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় কেন বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সফরকে গ্রহণ করল? অনুশীলনস্থলে পাক ক্রিকেট দল সাহস করে পতাকা উড়িয়েছে। আর খেলার মাঠে যারা পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে সমর্থন করে পতাকা বহন এবং সমর্থন করেছে তারাও হয়ত অর্থের বিনিময়ে ভাড়া করা হতে পারে আবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও তা করতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের ময়দান থেকেই হাজারও ষড়যন্ত্রের পরেও দেশটা স্বাধীন হয়েছে। যেদিন বিজয় অর্জিত হয়েছিল সেদিনও কি ষড়যন্ত্র বন্ধ ছিল? মোটেই নয়। সেদিনও অনেকে মনে করেছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। সেই ষড়যন্ত্রেরই ধারাবাহিকতায় মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ঘটে যায় ১৯৭৫ ট্র্যাজেডি। এরপর পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রে অনেক জল গড়িয়েছে। ৭১-এর শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তান এমনকি প্রতিবেশী মিত্ররাষ্ট্র ভারতের থেকেও হয়ত অর্থনৈতিক সূচকে উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু দেশপ্রেমের উন্নয়ন হয়েছে বলে মনে হয় না। সাম্প্রতিক ঘটনা তাই যেন সাক্ষ্য দেয়। এই অন্তঃসারশূন্যতা দূর করার জন্য দেশপ্রেমের দীক্ষায় দীক্ষিত করতে দরকার ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা। মানুষের মনে দেশপ্রেমে জাগ্রত করার জন্য ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন আছে। কোনোভাবেই এই অসহনীয় পরিস্থিতি কাম্য হতে পারে না শুভবোধসম্পন্ন কারোরই।
মন্তব্য করুন