যুক্তরাষ্ট্রে লবিং ইস্যুতে সরকার ও বিএনপির মধ্যে বাগ্‌যুদ্ধ চলছে। তবে বিশিষ্টজন মনে করেন, কে কী স্বার্থ ও উদ্দেশ্যে লবিস্ট নিয়োগ করছে; কীভাবে কত টাকা দিয়েছে লবিস্ট ফার্মকে- স্বচ্ছতা রক্ষায় তা প্রকাশ করা উচিত।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, মার্কিন আইনানুযায়ী লবিস্ট নিয়োগ অবৈধ নয়। বাংলাদেশের আইনে এ বিষয়ে কিছু বলা নেই। সরকার লবিস্ট নিয়োগ করতেই পারে। কিন্তু কী কারণে নিয়োগ করেছে; স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার স্বার্থে তা প্রকাশ করা উচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করার জন্য সরকারের সব রকম আইনি অধিকার রয়েছে। লবিস্ট নিয়োগ দোষের নয়। দেখতে হবে কী উদ্দেশ্যে, কার স্বার্থে নিয়োগ করা হয়েছে। যেমন যুদ্ধাপরাধের বিচার থামাতে লবিস্ট নিয়োগ হয়েছিল। তা সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু দেশ ও জনগণের স্বার্থে যেখানে লবিস্ট নিয়োগ হয়, তা কূটনৈতিক নীতিতে অনৈতিক নয়।

মানবাধিকার ইস্যুতে র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনীর সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা লবিং বিতর্ককে রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। সরকার ও আওয়ামী লীগের অভিযোগ, বিএনপির ভাড়া করা তদবিরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি সরকারগুলোকে বাংলাদেশে আইনের শাসন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও নির্বাচন সম্পর্কে ভুল তথ্য দিচ্ছে। যার ফল র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা।

মার্কিন তদবিরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ সরকার গত আট বছরে ২৪ লাখ ডলার খরচ করেছে লবিং বাবদ। কী উদ্দেশ্যে সরকার লবিস্ট নিয়োগ করছে- এ প্রশ্ন তোলা বিএনপি লবিং বাবদ ৩৭ লাখ ডলার ব্যয় করেছে বলে অভিযোগ করেছেন মন্ত্রীরা। যদিও বিএনপি নেতারা এ অভিযোগের সত্যতা নাকচ করে বলেছেন, তারা লবিস্ট নিয়োগ করেননি। বরং আওয়ামী লীগ জনগণের টাকায় লবিস্ট ভাড়া করে ধরা পড়ে বিএনপির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছে।

সরকারের মন্ত্রীরা যুক্তরাষ্ট্রে লবিং প্রতিষ্ঠান নিয়োগের বিষয়টি স্বীকার না করলেও জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান ভাড়ার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তাদের দাবি, সরকার দেশের স্বার্থে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। কিন্তু বিএনপি দেশবিরোধী অপপ্রচার চালাতে লবিস্ট ভাড়া করেছে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকার তদবিরকারী প্রতিষ্ঠানকে যে ফি দিয়েছে, তা জনগণের টাকা। তাই স্বচ্ছতার স্বার্থে, সরকারের উচিত জনসমক্ষে প্রকাশ করা- কীভাবে কত টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। সরকার ও প্রশাসনের মধ্যে গোপনীয়তার চর্চা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশ করা তথ্য থেকে জানা গেল, সরকার সে দেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। সরকার যদি নিজে থেকে এ তথ্য আগেই জানাত, তাহলে বিতর্ক হতো না।

তবে অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, সরকারের এখতিয়ার রয়েছে সব তথ্য প্রকাশ না করার। সরকার বাংলাদেশের পক্ষে নীতি প্রণয়নেই লবিস্ট নিয়োগ করবে। কিন্তু সরকারের বাইরে যারা লবিস্ট নিয়োগ করেছে, তারা কী কারণে ভাড়া করেছে, তা প্রকাশ করা উচিত।

যুক্তরাষ্ট্রে হাজারো নিবন্ধিত তদবিরকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যারা ব্যবসায়ী, কৃষক, পরিবেশবাদী, রাজনীতিকসহ যে কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থের পক্ষে মার্কিন সরকারের নীতি প্রণয়ন, পরিবর্তন ও পরিমার্জনে কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নকারী মন্ত্রী, আইন প্রণেতা, রাজনীতিক, কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করতে চেষ্টা করে। বিদেশি নাগরিক, প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল কিংবা সরকারও যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত হিসাব প্রকাশ করে। গ্রাহক ও চুক্তির বিষয়ে মার্কিন সরকারকে জানাতে হয়। গ্রাহকের কাছ থেকে কত টাকা নিয়ে, কী কাজ করেছে তা জানাতে হয়। বিজিআর গভর্নমেন্ট অ্যাফেয়ার্স নামে লবিং প্রতিষ্ঠান গত বছর অক্টোবরে তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর তাদের তিন লাখ ২০ হাজার ডলার দিয়েছে। তার আগের বছর ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের জন্য এক লাখ ৬০ হাজার ডলার দিয়েছে বিজিআরকে। ২০২১ সালে ৭৫ হাজার ডলারে ফ্রিডল্যান্ডার কনসাল্টিং গ্রুপ এবং কোনওয়াগো কনসাল্টিং নামে দুটি প্রতিষ্ঠানকে স্বল্প মেয়াদে নিয়োগ করেছিল সরকার।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সংসদে এবং সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিএনপি লবিস্ট ভাড়া করেছে। প্রায় পৌনে চার মিলিয়ন ডলার এ বাবদ দিয়েছে। যদিও প্রতিমন্ত্রী জানাননি, কোন কোন প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া করেছে বিএনপি।

লবিং ফার্মগুলোর প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নির্বাচন সম্পর্কে লক্ষ্য তুলে ধরতে বিএনপি ২০১৮ সালে এক লাখ ৬০ হাজার ডলারে ব্লু স্টার স্ট্র্যাটেজিস্ট নামে এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকতে ২০০৫ থেকে তিন বছরে ১২ লাখ ৬০ হাজার ডলার খরচ করেছিল লবিং বাবদ।

ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, সরকার কোন খাত থেকে লবিংয়ের জন্য টাকা খরচ করছে তা প্রকাশ করা উচিত। আর বিএনপি কীভাবে তদবিরকারী প্রতিষ্ঠানকে টাকা পরিশোধ করেছে, তাও প্রকাশ করা উচিত। যদি বৈধ মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে না থাকে, তাহলে অর্থ পাচারের মতো গুরুতর অভিযোগের বিষয়টি আসবে। সরকারের কাছে তেমন তথ্য থাকলে তা প্রকাশ করা উচিত। এতে আওয়ামী লীগের জন্যই ভালো হবে। কিন্তু তথ্য প্রকাশ না করে শুধু পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়ে স্বচ্ছতা আসবে না।

অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, কী উদ্দেশ্যে লবিং প্রতিষ্ঠান ভাড়া করা হচ্ছে, তা জানা জরুরি। কিন্তু বাকি সবকিছুর মতো এ বিষয়েও পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক বক্তব্য আসছে। রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে।