মাতৃভাষা বাংলার অধিকার সমুন্নত রাখতে সত্তর বছর আগে যে পথে রক্ত ঝরিয়েছেন রফিক-শফিক-বরকতরা, সে পথ ছেয়ে গেল শ্রদ্ধার ফুলে। আগত সবাই শ্রদ্ধায় অবনত মস্তকে একযোগে গাইলেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি… আমি কি ভুলিতে পারি…।’

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। রক্তের দামে এসেছিল বাংলার স্বীকৃতি আর তার সিঁড়ি বেয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। 

মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির এই আত্মত্যাগের দিনটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বে। গর্ব আর শোকের এই দিনটি বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করেছে জাতি। 

করোনাভাইরাস মহামারীতে গত দুই বছর ধরেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সব আয়োজন সীমিত করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে প্রতিপালনের মধ্যে দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের অনুষ্ঠানটি আয়োজন করছে সরকার।  

করোনাভাইরাস মহামারির সংক্রমণ পরিস্থিতিতে এবছর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে  শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেননি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তাদের পক্ষে রোববার রাত ঠিক ১২টা ১ মিনিটে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাউদ্দিন ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী। 

শ্রদ্ধা জানানো হয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, শাজাহান খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিকে। 

জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সংসদ সচিবালয়ের সার্জেন্ট আ্যট আর্মস কমডোর মিয়া মোহাম্মদ নাইম রহমান।। 

বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মিশনের সদস্যরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। 

তিন বাহিনীর প্রধানদের মধ্যে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের পক্ষে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শাহীন ইকবাল এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। 

বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষে আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন শহীদ মিনারের বেদিতে।

সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির পক্ষে মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা শহীদ বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানায় এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধি দল। 

এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদসহ মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যরা।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ কেন্দ্রীয় শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। 

সংগঠনের সভাপতি নির্মল রঞ্জন গুহ ও সাধারণ সম্পাদক জননেতা আফজালুর রহমান বাবুর সঙ্গে শ্রদ্ধা নিবেদনে আরও অংশ নেন কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি কাজী মোয়াজ্জেম হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল সায়েম, শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ড. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া কাঞ্চন, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ছাইফুর রহমান ছিন্টু, উপ যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক জসীম উদ্দিন মাদবর প্রমুখ।

এবারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বহুভাষায় জ্ঞানার্জন: সংকট এবং সম্ভাবনা’। 

ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষায় একুশ অনুপ্রেরণার উৎস: রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ

শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মাতৃভাষা বাংলার অধিকার আদায়ে জীবন উৎসর্গকারী ভাষাশহীদ রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা শহিদদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। 

দিবসটি উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে তিনি স্মরণ করেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যিনি ১৯৪৮ সালে মাতৃভাষার দাবিতে গঠিত ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এর নেতৃত্ব দেন এবং কারাবরণ করেন। 

তিনি আরও স্মরণ করেছেন তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ সকল ভাষা সংগ্রামীকে, যাদের দূরদৃষ্টি, অসীম ত্যাগ, সাহসিকতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০২২ উপলক্ষে বাংলাসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণ ও জাতিগোষ্ঠীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মাতৃভাষা এবং নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে এ দিবসটি উদযাপন একটি অনন্য উদ্যোগ।’

বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় অমর একুশের চেতনা আজ অনুপ্রেরণার অবিরাম উৎস। ’

এ চেতনাকে ধারণ করে পৃথিবীর নানা ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগসূত্র স্থাপন, লুপ্তপ্রায় ভাষাগুলোর পুনরুজ্জীবন, নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বারোপ করেন মো. আবদুল হামিদ।

তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নিজস্ব জাতিসত্তা, স্বকীয়তা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষারও আন্দোলন। আমাদের স্বাধিকার, মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অমর একুশের অবিনাশী চেতনাই যুগিয়েছে অফুরন্ত প্রেরণা ও অসীম সাহস।’

বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা থাকলেও বর্ণমালা নেই। কারও ভাষাই আবার হারিয়ে যেতে বসেছে। সেসব জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণে গুরুত্বারোপ করেন রাষ্ট্রপতি।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। এর মধ্যে অনেকগুলো ভাষার সুনির্দিষ্ট লিখিত রূপ নেই। এসকল ভাষার সংরক্ষণ ও উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণে আমি সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’

বিপন্ন ভাষা রক্ষায় বিশ্ববাসীকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।

মো. আবদুল হামিদ বলেন,  ‘কালের আবর্তে পৃথিবীতে অনেক ভাষাই আজ বিপন্ন। একটা ভাষার বিলুপ্তি মানে একটা সংস্কৃতির বিলোপ, জাতিসত্তার বিলোপ, সভ্যতার অপমৃত্যু। তাই মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশসহ সকল জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় বিশ্ববাসীকে সোচ্চার হতে হবে।’ 

সর্বস্তরে শুদ্ধ বাংলার প্রচলনের আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন. ‘একই সাথে যে বাংলা ভাষার জন্য আমরা জীবন দিয়েছি তার উন্নয়নে সর্বস্তরে শুদ্ধ বাংলার প্রচলনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে আজ আমরা গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা।’

শহীদের আত্মত্যাগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাঙালি  জাতীয়তবাদ: শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একটি অসম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ভিত রচিত হয়েছিল।’ 

প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে স্মরণ করেন আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, রফিকউদ্দিন আহমদ, শফিউর রহমানসহ আরও অনেককে, যারা ১৯৫২ সালের এ দিনে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা করতে প্রাণোৎসর্গ করেছিলেন। 

তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাসহ বিশ্বের সকল ভাষা-শহিদগণের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। সেই সঙ্গে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে  নেতৃত্বদানকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল ভাষাসৈনিকদের, যাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ এবং সংগ্রামের বিনিময়ে আমাদের মা, মাটি ও মানুষের মর্যাদা সমুন্নত হয়েছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ বাঙালির গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস যুগে যুগে আমাদের জাতীয় জীবনে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে। 

ভাষা আন্দোলনে বাঙালি কৃতি সন্তানদের চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে বাণীতে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। 

শে হাসিনা ভাষা সংরক্ষণ, চর্চায় তার সরকারের নানামুখী অবদানের কথা তুলে ধরে বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছি। বিলুপ্তপ্রায় ভাষা সংরক্ষণ ও তাদের মর্যাদা রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করেছি। নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষা ও বর্ণমালাকে বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করার জন্য ২০১৭ সাল থেকে তাদের ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রবর্তন করেছি। 

তিনি জানান, চলতি বছর সরকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় প্রায় ৩৩ হাজার বই বিতরণ কররেছে । 

বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি নেওয়ার চেষ্টার কথাও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।