- চতুরঙ্গ
- সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ দেওয়াই বড় চ্যালেঞ্জ
বিশেষজ্ঞ মত
সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ দেওয়াই বড় চ্যালেঞ্জ

যখন দেশে বিদ্যুৎ সুবিধা ৫০ শতাংশ মানুষ পেত তখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়াটাই মূল লক্ষ্য। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তাদের মেনিফেস্টোতে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই লক্ষ্য পূরণে গত কয়েক বছর তারা নিরলসভাবে কাজ করে গেছে। ফলে দেশের বেশিরভাগ এলাকায় তারবাহী বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। যেসব এলাকায় লাইন নেওয়া সম্ভব হয়নি সেখানে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে ঘর আলোকিত করা হয়েছে। তবে মানসম্মত ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এখনও দেওয়া যায়নি। ফলে এটা বলা যায়, লক্ষ্যমাত্রার প্রথম ধাপটি অর্জিত হয়েছে। এখন দ্বিতীয় ধাপের দিকে এগোতে হবে। কীভাবে মানসম্মত বিদ্যুৎ সার্বক্ষণিকভাবে গ্রাহককে দেওয়া যায় সে বিষয়ে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ দেওয়ার প্রচেষ্টা থাকতে হবে। এটা তুলনা করা যায় শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে। এক সময় দেশের অনেক এলাকাতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। এখন দেশের আনাচে-কানাচে সব জায়গায় বিদ্যালয় আছে। শিক্ষার সুযোগ সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু শিক্ষার মান নিয়ে নানা অভিযোগ উঠছে। এখন মানসম্মত শিক্ষার জন্য কাজ করতে হবে। বিদ্যুতের বিষয়টাও তেমন।
অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে একটি তারের মাধ্যমে। রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি রক্ষায় এ কাজ করা হয়েছে। কিন্তু এতে গুণগত মান বজায় রাখা হয়নি। এ ছাড়া ভবিষ্যৎ চাহিদার কথা মাথায় রেখে বিতরণ ব্যবস্থা করা হয়নি। এক জায়গায় বিদ্যুৎ গেলে দ্রুত এর চাহিদা বাড়ে। দেখা যায় অনেক গ্রাম এলাকায় বিদ্যুৎ গেলেও তিন-চার ঘণ্টার লোডশেডিং হচ্ছে। কারণ বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার সময় চাহিদা বৃদ্ধির কথা মাথায় না রেখেই বিতরণ লাইন দেওয়া হয়েছে। যে লাইন আর ট্রান্সফরমার বসানো হয়েছে তা বাড়তি চাহিদা পূরণে সক্ষম নয়।
আরেকটি চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে তাহলো বিদ্যুতের জন্য সাশ্রয়ী প্রথমিক জ্বালানি। কারণ বিশ্বব্যাপী তেল, গ্যাস, কয়লা সব পণ্যের দাম বেড়ে আকাশচুম্বী। কিছুদিন আগেও সরকার বড় কয়েকটি বাদে বাকি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বন্ধ করার কথা বলেছিল। এলএনজি দিয়ে বিদ্যুৎ প্রকলের কথা বারবার বলা হতো। কিন্তু এখন এলএনজির দাম নাগালের বাইরে। গত বছর যে গ্যাস ৫ থেকে ১০ ডলারে পাওয়া যেত তা এখন ৫০ ডলার। কয়লার দাম টনপ্রতি ৮০-৯০ ডলার ছিল বছরখানেক আগে। এখন তা ৪৫০ ডলার হয়ে গেছে।
তবে এটা বলা যায়, বিদ্যুৎ থাকা না থাকা জীবনের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলে। যেসব গ্রামে বিদ্যুৎ গেছে সেখানে কর্মঘণ্টা বেড়ে যায়। মুদিদোকান থেকে শুরু করে কুটিরশিল্প সব জায়গায় সন্ধ্যার পরও কাজ করতে দেখা যায়। এতে উৎপাদন বেড়ে যায়, যা জনগণের জীবন ও জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলে। অবশ্যই শিক্ষার প্রসার ঘটে। শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যার পরও লেখাপড়া করে। জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য আনে বিদ্যুৎ। ফ্যান ঘোরে, টেলিভিশন চলে। পানি তোলা, কাপড় ধোয়ার কাজও বিদ্যুৎ করে।
পায়রাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের জন্য একটা মাইলফলক। কারণ এটা সময়ের আগে এবং নির্ধারিত ব্যয়ের চেয় কম খরচে নির্মাণ করা হয়েছে। যা দেশের সব খাতের প্রকল্পের জন্য অনুকরণীয়। এটি সর্বাধুনিক সুপার ক্রিটিকাল পদ্ধতিতে নির্মাণ করায় পরিবেশ দূষণ তেমন হচ্ছে না। সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দূষণমুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। তবে সঞ্চালন লাইন না হওয়ায় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র দীর্ঘদিন বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বাড়তি অর্থ গুনতে হয়েছে। সামনে রামপাল আসছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আসছে সেসবের বিদ্যুৎ নেওয়ার ক্ষেত্রও এমন জটিলতা দেখা দিতে পারে। রূপপুর থেকে বিদ্যুৎ নেওয়ার সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ কাজ এখনও শুরুই হয়নি। এদিকে নজর দেওয়ার সময় এসেছে। না হলে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এসে বসে থাকবে।
সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। এখন বিশ্বব্যাপী সব জ্বালানির দাম ঊর্ধ্বমুখী। এই পরিস্থিতি সাময়িক। তবে এটা বলা যায়, দেশীয় গ্যাস সাশ্রয়ী হলেও কয়লা থেকেই তুলনামূলক কম দামে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। পায়রার বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ইউনিটপ্রতি ৬ টাকা ছিল। এখন কয়লার দাম বাড়ায় তা ৮ টাকা হয়েছে। তারপর এটি তেলভিত্তিক ১৪-২০ টাকার বিদ্যুতের চেয়ে সাশ্রয়ী। বিদ্যুতের সাশ্রয়ী উৎপাদনের পাশাপাশি ব্যবহারেও সাশ্রয়ী হতে হবে। জ্বালানি ও বিদ্যুতের অযথা ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। দক্ষ প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে। বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহারের জন্য সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবে।
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, বুয়েট
মন্তব্য করুন