
রাখী দাশ পুরকায়স্থ
রাখী বউদির সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরিচয় ঠিক কবে, কোথায়, কীভাবে ঘটেছিল তা আজ আর মনে নেই। তবে অবশ্যই তাঁর ঢাকার বাসায় বন্ধুবর পংকজ ভট্টাচার্যের মাধ্যমে পরিচয়ের পর থেকে বউদি আপনাতে আপনি ভাস্বর। কে কার চেয়ে বেশি আদর, সম্মান, ভালোবাসা দিয়েছেন, তা আলোচনার ব্যাপার। পংকজ বাবু অত্যধিক ঘনিষ্ঠ তবে সেটা মূলত রাজনৈতিক কারণে। সেই ১৯৭২ সাল থেকে আজতক, অর্থাৎ প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে এই দলের পতাকাতলে কাজ করে চলেছি সে কারণেই প্রধানত।
কিন্তু রাখী বউদি? পংকজ বাবুর সহধর্মিণী; সেই কারণে কি? সেটা কিছুটা; কিন্তু সে পরিচয় মুখ্য থাকেনি বউদির অতুলনীয় আন্তরিকতা, সাদামাটা আচার-আচরণ এবং কথাবার্তায়। পরিচয় ঘটার পর কতদিন যে তাঁর বাসায় থেকেছি, খেয়েছি, গল্প করেছি; বেদনার সঙ্গেই তা আজ স্মরণে আসছে। অত্যন্ত ব্যথিত বোধ করি যখনই ভাবি, অত্যন্ত আপন ওই বউদিকে শেষ দেখাটা দেখতে পারলাম না! শেষ শ্রদ্ধা, শেষ বিদায় জানাতে পারলাম না!
সিলেটের প্রখ্যাত আইনজীবী অ্যাডভোকেট বিরজা মোহন দাশ পুরকায়স্থ তাঁর পিতা এবং বিপ্লবী চেতনার ধারক তাঁর মা ঊষা দাশ পুরকায়স্থ। ১৯৫২ সালের সংগ্রামমুখর বছরের ইতিহাসখ্যাত মাস ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন রাখী দাশ পুরকায়স্থ। বড় হয়ে ছাত্র ইউনিয়ন,অতঃপর মহিলা পরিষদের নেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন গৌরবের মাসে, অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে উভয় সংগঠনের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
বাল্যকালে সিলেট শহরেই শিক্ষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অংশ নেন রাখী দাশ পুরকায়স্থ। মা ঊষা দাশ পুরকায়স্থ, যাঁকে আমি ও আমার সহধর্মিণী পূরবী মাসিমা বলে ডাকতাম। একবার সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন বরিশালের মনোরমা মাসিমা, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও গোপন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শহীদুল্লা কায়সার। সেই সুবাদে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের নানা কাহিনি শুনে আন্দোলন সংগঠনে উৎসাহী হয়ে ওঠেন রাখী দাশ পুরকায়স্থ। ঘনিষ্ঠতাও বাড়ে মনোরমা মাসিমার সঙ্গে।
একজন প্রথম শ্রেণির সংগঠক ও ছাত্রনেতা হয়ে ওঠা এবং আন্দোলনমুখিনতার কারণে এক পর্যায়ে তাঁকে সিলেট মহিলা কলেজ থেকে টিসি দেওয়া হয় ভালো ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও। তখন শহীদুল্লা কায়সার ও জননেত্রী বেগম সেলিনা বানুর সহায়তায় তিনি কুমিল্লায় ভর্তি হলেও সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকেননি। কুমিল্লা শহরের তৎকালীন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলও তাঁর মানসজগৎ ও জীবনের গতিধারাকে অনেকটা বদলে দেয়। তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে শিরীণ বানু মিতিল, নীলিমা পাল, সুদীপ্তা সিনহা প্রমুখ বিপ্লবী নারীর সঙ্গে।
১৯৭১ সালে এক সময় ঢাকা শহর উত্তাল নগরীতে পরিণত হলে বউদির বাবা নিরাপত্তার কারণে সিলেট নিয়ে যান। তৎকালীন গোপন কর্মীদের সঙ্গে যে মেয়েরা কাজ করতেন, রাখী বউদির তাঁদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ সিলেট শহরে এক বিশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭০-এর নির্বাচনের রায় দ্রুত মেনে নেওয়া এবং রাষ্ট্রক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর কাছে হস্তান্তরের দাবিতে। এর মুখ্য নেতৃত্বে ছিলেন ঊষা দাশ পুরকায়স্থ, খোদেজা কিবরিয়া, নীল চৌধুরী, শেফালি চক্রবর্তী প্রমুখ। পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় ২৫ মার্চ গভীর রাতে গণহত্যা চালায়।
রাখী দাশ পুরকায়স্থ ১৯৭১ সালের জুন মাসে ভারতের আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলার করিমগঞ্জে চলে যান সিলেটের বিয়ানীবাজারের জকিগঞ্জ বর্ডার দিয়ে। সেখানে তিনি শরণার্থীদের মধ্যে সেবামূূূূলক কাজ, মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ, জনসংযোগ এবং সভা-সমিতিতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে প্রচারমূলক কাজে অংশগ্রহণ করেন। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের করিমগঞ্জ হাসপাতালে সেবাদানেও নিযুক্ত ছিলেন।
দেশে ফিরে এসে ১৯৭২ সালে ছাত্র ইউনিয়নের মনোনয়নে ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে বিপুল ভোটে সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে ছাত্র ইউনিয়নের মনোনয়নে বিপুল ভোটে ভিপি নির্বাচিত হন।
১৯৭৪ সালের ১০ জুলাই রাখী দাশ পুরকায়স্থ পংকজ ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্বামী বাম আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তখন তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক।
রাখী দাশ পুরকায়স্থ অনেক দিন ধরে লিভার সিরোসিস রোগে ভুগছিলেন। পরে তাঁর উন্নততর চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় আসামের গুয়াহাটিতে। ভর্তি করা হয় অ্যাপোলো হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ২০২০ সালের ৬ এপ্রিল তিনি পরলোকগমন করেন।
বউদি, তোমাকে ভুলব না। আমরা কেউই না। বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে তোমার নামটি গৌরবের সঙ্গে উচ্চারিত হবে। কবির ভাষায় বলি, 'স্মরণের আবরণে মরণেরে যত্নে রাখে ঢাকি।'
রণেশ মৈত্র :রাজনীতিক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
raneshmaitra@gmail.com
মন্তব্য করুন