- চতুরঙ্গ
- চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমছে কেন?
ওষুধের দাম
চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমছে কেন?

অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যস্ফীতির মধ্যেই হঠাৎ করে এ বছরের মাঝামাঝি পর্যায়ে জীবন রক্ষাকারী আমাদের ৫৩টি নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি প্রচলিত আইন সংশোধনের মাধ্যমে সমগ্র দেশে যদি সব প্রকার ভেজাল, নকল বা জালিয়াতির বিরুদ্ধে আইন সংস্কার না করা হয়, তাহলে নকল ওষুধ দিয়ে বাজার আরও বেশি সয়লাব হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। সেজন্য ড্রাগ স্টোরগুলো থেকে রেজিস্টার্ড ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকসহ সব জীবন রক্ষাকারী ওষুধ বিক্রিতে জিরো টলারেন্সে আনতে হবে আর সেই সঙ্গে ভুয়া চিকিৎসক ও ভুয়া ডায়াগনস্টিক রিপোর্টকারীদের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আইন প্রণয়ন করতে হবে। তা না হলে এ দেশের ওষুধ ও চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা আরও কমে যাবে। আস্থাহীনতার কারণে চিকিৎসাসেবার জন্য এ দেশ থেকে প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে। আক্ষেপের বিষয় হলো, এর বিরুদ্ধে চিকিৎসকদের বৃহত্তম সংগঠন বা বিএমএ তেমন কোনো কার্যকারী পদক্ষেপ নেয়নি।
আমাদের দেশ আগামী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী এলডিসি (নিম্ন আয়ের দেশ) থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার কথা ২০২৬ সালে। মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হলে ২০২১ সালের ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের নীতিমালা অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রচলিত ইনডিভিজুয়াল ইন্টালেকচুয়াল প্রোপার্টির বা পেটেন্টের নিয়মানুযায়ী যে কোনো বিদেশি ওষুধ দেশে প্রস্তুত করতে হলে তার মূল্য কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর আয় তো বাড়ছে না।
১৯৮২ সালের ওষুধনীতি অনুসারে বর্তমানে বাংলাদেশ প্রায় ২ বিলিয়ন ইউএস ডলারের ওষুধ আমেরিকাসহ ১০০টি দেশে রপ্তানি করে আসছিল এবং আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তা প্রায় ৫ বিলিয়ন ইউএস ডলারের দিকে ধাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হলে ২০২৬ সালের পর থেকে ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের আন্তর্জাতিক সম্পদ অধিকারের (পেটেন্ট) নীতিমালা অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলো বা বাংলাদেশের জন্য যে রয়ালিটির অর্থ ছাড় দেওয়া হয় তা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে, হয়তোবা এই গ্রেস পিরিয়ডে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হবে। কারণ আমাদের জন্য আশঙ্কার বিষয় হলো এটাই, আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের এক-পঞ্চমাংশই ড্রাগ বা মেডিসিন বিদেশি পেটেন্টের আওতাধীন।
আমাদের দেশের ১৯১১ সালের পেটেন্ট আইন অনুযায়ী এবং ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের আন্তর্জাতিক সম্পদ অধিকারের (পেটেন্ট) বাণিজ্য-আইন অনুযায়ী আমরা পেটেন্ট সুবিধা ভোগ করতে পারি কেবল ১৬ বছরের জন্য, ২০ বছরের জন্য না। পেটেন্ট-প্রোটেকশন আইন উদ্ভিদ বা অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সুতরাং এসব ওষুধও চার বছরের মধ্যে দেশে প্রস্তুত করতে হবে। ১৯৮২ সালের ড্রাগ কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী বর্তমানে দেশে বিদেশি ওষুধ আমদানি করতে অনুমোদন, মূল্য নির্ধারণ, মোড়কজাত করতে হয় এবং দেশে তৈরি হয় এমন কোনো ওষুধ আমদানি নিষিদ্ধ। উইভারমুক্ত পেটেন্ট লাইসেন্সের সুযোগে বাংলাদেশ বর্তমানে পেটেন্ট লাইসেন্সবিহীন দেশ যেমন ভিয়েতনাম, মিয়ানমার বা কেনিয়াতে রপ্তানি করে এইডস বা ক্যান্সারের ড্রাগ; এই বাণিজ্যে লাভ হয়, মানুষের কর্মসংস্থান হয় এবং প্রয়োজনীয় জিনিস পক্ষান্তরে আমদানি করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো কিছুর মূল্যবৃদ্ধির সরকারি ঘোষণাকে আমাদের লোকাল বাণিজ্য সিন্ডিকেট ঈদ মনে করে, কোনো নিয়মের মোটেও তোয়াক্কা করে না, তারা গন্ধ পাওয়া মাত্র স্বেচ্ছায় যথেচ্ছ দাম বাড়িয়ে ফেলে- যার কোনো প্রাইসগেজ নেই। যে দেশে কোরবানি ঈদের আগের দিন টমেটোর দাম হাঁকে ৪০০ টাকা কেজি আর ঈদের তিন দিন পর টমেটোর দাম হাঁকে ৮০ টাকা কেজি। সে দেশের মানুষের বিবেক বা ধর্মের পবিত্রতা বা মনুষ্যত্ব কোথায়? লোকাল বাণিজ্য সিন্ডিকেট দিনের পর দিন পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, সবজি বা চাল নিয়ে বেশ্যাদের চেয়েও খারাপভাবে বাটপারি করে অথচ গ্রামের কৃষক তার প্রাপ্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। হাসপাতালে গেলে ডাক্তার, নার্স বা রোগীর চেয়ে ক্লিনিকের দালাল বা ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভদের হাঁকডাক বা লম্ম্ফঝম্প বেশি দেখা যায়; ডাক্তার হয়ে করোনার ভুয়া রিপোর্টের সঙ্গে স্বয়ং ডাক্তারই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত হয়; সরকারি অ্যাম্বুলেন্স, এক্স-রে মেশিন, এমআরআই মেশিন, সিটিস্ক্যান মেশিন নষ্ট থাকে। অথচ হাসপাতালের পাশেই ক্লিনিকে সবকিছু উচ্চমূল্যে সহজে পাওয়া যায়। সুতরাং দেশে যখন জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মূল্য সরকারিভাবে বাড়বে বা অপ্রতুল হবে, তা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক বাস্তবতা।
মন্তব্য করুন