
অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও মঙ্গলকাব্যের সর্বশেষ শক্তিমান কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ভাষায়, 'নগর পুড়লে কি দেবালয় এড়ায়?' স্বদেশ প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের কাছে দেবালয়ই। করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব আজ বিশ্বের সর্বত্র স্পষ্ট। পৃথিবীর উত্তর থেকে দক্ষিণ সব জায়গায় জ্বালানি, খাদ্য, অর্থ সংকট চলছে এবং নতুন নতুন সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। বাংলাদেশেও তার প্রভাব আছড়ে পড়তে শুরু করেছে। সামনের দিনগুলোয় আরও প্রভাব পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আগে থেকেই সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অর্থনীতির দেশ ছিল আফগানিস্তান। পাকিস্তান ও নেপালও এখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত। শ্রীলঙ্কায় গত বছর থেকেই ভয়াবহ রূপে জ্বালানি, খাদ্য, অর্থ সংকট চলছে। সার্কভুক্ত আটটি দেশের মধ্যে চারটি দেশেই চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে এবং এই বিপর্যয়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও মোটামুটি একই ধাঁচের- বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ঘাটতি, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি জনিত কারণে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, রাজনৈতিক প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতির প্রসার, অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্পের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয়, বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধে অপারগতা ইত্যাদি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, 'বিশ্ব অর্থনীতি এরই মধ্যে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। দুর্বল হতে থাকা অর্থনৈতিক সূচকগুলো বলছে, সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।' ইউরোপে ক্রমবর্ধমান জ্বালানি সংকট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত করার পাশাপাশি মূল্যম্ফীতি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। বৈশ্বিক সরবরাহ সংকটের কারণে গত বছর সারাবিশ্বের মতো ইউরোপের অর্থনীতি গতি হারিয়েছে। সম্প্রতি আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলের সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে। ছোট্ট দেশে বিপুল জনসংখ্যার মুখে খাবার জোগানো এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমাদের খাবারের একটি বড় অংশ মিটে আমদানি করা খাদ্যপণ্যে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। এই আকাশ ছোঁয়া দামে খাদ্যপণ্য আমদানি করতে গিয়ে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রায় টান পড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে তেল-গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। যার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ উৎপাদন নিদারুণ সংকটে পড়েছে। বাদ যাচ্ছে না ইউরোপের উন্নত দেশগুলোও। প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করে আমরাও বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে পারছি না। যার কারণে আমাদের শিল্পপণ্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটছে। উচ্চমূল্যে খাদ্য ও জ্বালানি আমদানি করতে গিয়ে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র এক বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার কমেছে। ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সংগতি না হওয়ায় রিজার্ভ কমছে। আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য গার্মেন্টের বড় বাজার ইউরোপের দেশগুলো। সেই দেশগুলোই নানা সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে। তাই প্রয়োজনীয় অর্ডার আসছে না। যাও আসছে, জ্বালানি সংকটে নিরবচ্ছিন্ন ফ্যাক্টরি চালাতে না পারায় সময়মতো সরবরাহ ঠিক রাখতে পারছে না দেশীয় কোম্পানিগুলো। আমাদের আরেকটি বড় খাত রেমিট্যান্স প্রবাহও ধীরগতিসম্পন্ন হয়ে পড়েছে। যার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতির দিকে।
কয়েক দিন আগে দেখলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে ব্যাংক থেকে জনগণকে আমানত তুলে নিতে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ যেন স্বাধীনতা লাভ করতে না পারে, সে জন্য যুদ্ধের ময়দানে যেমন ষড়যন্ত্র হয়েছিল; আজকে পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহ এ সংকটকালেও তেমনিভাবে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমার প্রশ্ন- ধরুন, বর্তমানে যারা দেশ পরিচালনা করছে, সেই সরকারকে বিদায় করে সরকারবিরোধী পক্ষ রাষ্ট্রক্ষমতায় এলো; তাহলে তারা কি এমন সংকট থেকে দেশকে উদ্ধার করতে পারবে? সহজ উত্তর- পারবে না। বরং ষড়যন্ত্র না করে সবাই মিলে মোকাবিলা করাটাই হতে পারে এ সংকটের উত্তম পন্থা।
প্রশ্ন জাগে- বৈশ্বিক সংকটের টালমাটাল অবস্থায় বাংলাদেশও গভীর খাদে পড়বে কিনা? একবাক্যে এর উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে এটুকু প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়, করোনা-উত্তর পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি এখন যেদিকে মোড় নিচ্ছে, তাতে ওই ঝুঁকি বাংলাদেশের জন্যও কমবেশি রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে ঘোর অন্ধকার এরই মধ্যে নেমে এসেছে। সব ক্ষেত্রে উচ্চ পণ্যমূল্যের কারণে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের মৌলিক চাহিদা মেটানো এরই মধ্যে কঠিন হয়ে পড়েছে। সমাজে অনিয়ম, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তপনায় মানুষ অতিষ্ঠ। কাজেই রাষ্ট্রের চালকদের উচিত সংকট আরও গভীরে যাওয়ার আগেই এ ব্যাপারে নানামুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে আগাম সতর্কতামূলক প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
মন্তব্য করুন