পারুল সর্বংসহা নন

মাধব দীপ
প্রকাশ: ১৩ মে ২০২০ | ১০:৫৮ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর -০০০১ | ০০:০০
আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন সাংবাদিক-বন্ধুর ফেসবুক-ওয়ালে একটি ঘটনা ঘুর-পাক খাচ্ছে। ঘটনাটি নিয়ে দুয়েকটি লেখাও চোখে পড়েছে। একাত্তর টিভিতে প্রচারিত হওয়া ১৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের একটি টকশো'ও ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। তাই, ভাইরাল হওয়া বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আমি বলছি না। ঘটনা সংক্ষেপ এই- দুটি জনপ্রিয় ও মূলধারার সংবাদপত্রের কর্মী সাজিদা ইসলাম পারুল ও রেজাউল করিম প্লাবন। তাদের ভাষ্যমতে, গত বছরের ডিসেম্বরে দু’জনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এপ্রিলের দুই তারিখ গোপনে বিয়ে করেন তারা । আর এরপর ঘটনাচক্রের নির্মমতায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন পারুল। নষ্ট হয়ে যায় তার গর্ভে আসা ভ্রুণ। অভিযোগের তীর প্লাবনের বিরুদ্ধে। প্লাবন আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজের কথা তুলে ধরেছেন ফেসবুকে।
প্রশ্ন উঠেছে— ব্যক্তিগত জীবনের এই ঘটনাবলি কেনো সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্থাপন করা হলো? কেনো তা মূলধারার গণমাধ্যমে খুব একটা জায়গা করে নিতে পারল না? এটা কি মিডিয়া ট্রায়াল হলো? নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে মূলধারার গণমাধ্যমের জন্য এটা কতোটুকু প্রাসঙ্গিক? গণমাধ্যমের নীতি-নৈতিকতা নিয়ে আমি যেহেতু বেশ কয়েক বছর ধরে পাঠদান করছি, ছাত্রাবস্থায়ও পড়েছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়েও পড়াশোনা নেহায়েত কম করিনি. যতোটুকু বুঝি তাতে মনে হচ্ছে— এই বিষয়গুলো নিয়ে কিছু লেখা জরুরি। বলে রাখা দরকার এককথায় মিডিয়া ট্রায়াল বলতে আমরা বুঝি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই কাউকে দোষী হিসেবে বিচার করা বা রায় দেওয়া।
মহাভারতের একটি কাহিনি আমাদের অনেকেরই জানা। পাশা খেলায় পঞ্চপাণ্ডব হেরে যাওয়ায় ভরা রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করেছিলেন দুর্যোধন-দুঃশাসনরা। দ্রৌপদী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন এর প্রতিশোধ নেওয়ার। বলেছিলেন, যতদিন পর্যন্ত না এর প্রতিশোধ না পাবেন ততদিন পর্যন্ত চুল বাঁধবেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।
পারুল যেন জীবনের ‘পাশা খেলায়' হারিয়েছেন অনাগত সন্তান। এটাই নির্মম সত্য এখন পারুলের জীবনে। বিচারের আশায় তিনি মুখ খুলেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয়েছেন পারুলের বন্ধু ও স্বজনরা। প্লাবন নামক দুর্যোধনদের বিপরীতে প্রতিবাদী পারুলের 'অস্ত্র' সোশ্যাল মিডিয়া। ক্ষমতা-প্রাবল্যের ধারে-কাছে না থাকা নিভৃতে কাঁদা মানুষের আশ্রয়স্থল যে হতে পারে এই সোশ্যাল মিডিয়া, এটা এরই প্রমাণ।
২০১৯ সালের মে মাসে আমি জার্মানিতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। সারা পৃথিবী থেকে প্রায় আড়াই হাজার সাংবাদিক, গণমাধ্যম-শিক্ষাবিদ, সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট অংশগ্রহণ করেছিলেন। পুরো আয়োজনের মূলমন্ত্র ছিলো— ‘শিফটিং দ্যা পাওয়ার’। তার মানে মূলধারার গণমাধ্যমের ক্ষমতা ও শক্তি এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় শিফট করছে। আগে আমরা খবর শুনতে টেলিভিশনের রিমোট ঘুরাতাম এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলে। এখন শুয়ে-বসে-হাঁটতে-ফিরতে আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারস্থ হচ্ছি। ফেসবুকের ‘নিউজ ফিড’ এখন আমাদেরকে নিয়ে যায় ঘটনার উপরিতল থেকে তলদেশে। ফেসবুক ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া আজ আম-জনতাকে ক্ষমতায়িত করেছে। সংঘবদ্ধ করছে। সংহত করছে। ‘ভয়েসলেস’ মানুষকে ‘ভয়েস’ দেওয়ার যে কাজটি করার কথা ছিল মূলধারার গলমাধ্যমের, সেই কাজটি আজকাল প্রায়ই করছে সোশ্যাল মিডিয়া। এর উদাহরণ অজস্র। অবশ্য, এর বিপরীত উদাহরণও কম নয়। মুঠোফোনগুলো তাই হয়ে উঠছে আমাদের ‘তাৎক্ষণিক-পোস্ট-অফিস’। মাঠের আন্দোলনগুলোও হয়ে উঠছে ভার্চুয়াল। এটাই বাস্তবতা। এটাই পুঁজিবাদী সমাজের অনিবার্য, অলঙ্ঘনীয় ব্যাকরণ।
যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্লাবনের প্রতারণার অভিযোগের বিষয়টি না আসতো, তবে আমাদের সময় কই ছিলো সময় দেওয়ার? সুযোগ কই ছিলো জানার!
‘পারুলের সঙ্গে ঘটা নির্মমমতাগুলো’ ভাইরাল হওয়া মানে মূলধারার গণমাধ্যম এটিকে ‘জায়গা’ বা ‘সময় বরাদ্দ’ দিতে বাধ্য। কারণ, ভাইরাল হওয়ার বিচারে তা জনগুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে বঞ্চিত-মানুষের অভিযোগ তুলে ধরা মূলধারার গণমাধ্যমের সামাজিক দায়িত্বশীলতার অংশ। উপরন্তু, একাত্তর জার্নালের (একাত্তর টেলিভিশনে) সেই টকশো সাজিদা ইসলাম পারুল এবং রেজাউল করিম প্লাবন উভয়ের সম্মতিতেই করা হয়েছে। নাম-পরিচয় প্রকাশসহ অনুষ্ঠানে উভয়ের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে মাত্র— যা কোনোভাবেই 'মিডিয়া ট্রায়াল' নয়। তাছাড়া, ভাইরাল করা মানুষদের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসির ঘাটতি আছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। উপরন্তু, একজন নারী কতোটকু অসহায় হলে এই সমাজ-ব্যবস্থায় তা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশকে ইতিবাচক মনে করে, এটা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে এটা ভেবে স্যালুট জানাতেই হবে সাজিদা ইসলাম পারুলকে যে তিনি প্রথাগত সমাজ আর তার প্রচলিত পথকে তার জয়ের পথ-যাওয়ার পথ ভাবেননি। এক্ষেত্রে তিনি প্রথাবিরোধী। আর প্রথাবিরোধী হওয়া মানে তিনি এখন নিজেই একটা উদাহরণ। হয়তো পারুলের কাছ থেকে সাহস ধরে অনাগত দিনে অসংখ্য নারী রুখে দাঁড়াবে এরকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে। যারা বলছেন— সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয়টিকে মূলধারার গণমাধ্যমের বিষয় করা উচিত হয়নি, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন—নীরবে-নিভৃতে কেঁদে বিচার না পেয়ে প্রহসনের শিকার হওয়া পারুল আত্মঘাতী কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তখন বুঝি তা মূলধারার গণমাধ্যমের বিষয় হতো? দেশে তো এরকম অহরহই ঘটছে যে পুলিশ নির্যাতিত নারীর মামলা নিচ্ছে না। অতঃপর যখন সেই নারী গ্লানিতে আত্মহত্যা করছে, তখন ঠিকই মামলা নিচ্ছে। তবে কি একটা মামলা করার জন্য কারও মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে?
মনে পড়ছে রামায়ণের অন্যতম চরিত্র সীতার কথা— পৌরাণিক এই কাব্যে সীতার সতীত্ব নিয়ে একপর্যায়ে মিথ্যে কথা তোলা হয়। সীতা এর প্রতিবাদ না করে চুপ থেকে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সব অন্যায় মেনে নেন। প্রতিবাদে তিনি ধরণীকে শর্ত দিয়ে বলছিলেন, ‘যদি তিনি সতী হোন, তবে ধরণী যেনো দ্বিধা (দুই ভাগ) হয়ে যায়।’ ধরণী সেই কথায় সায় দিয়ে দুই ভাগ হয়ে গেলে সীতা পাতালে প্রবেশ করেন। ধরণী মানে পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পারল, সীতা সতী ছিলেন। কিন্তু ততোক্ষণে প্রজারা সীতাকে মর্ত্যলোকে চিরতরে হারিয়ে ফেলে। নিজেকে ‘নাই’ করে দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন সীতা ‘সত্য’ ছিলেন।
পারুলেরও কি চুপ থেকে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় নির্মিত সমাজব্যবস্থার কাছে নতি স্বীকার করে প্রতিকার-প্রতিরোধহীন বসে থাকা দরকার ছিলো? অধিকারহীনতার যাঁতাকলে পিষ্ট হতে-হতে আর দশটা নারীর মতো ডুকরে ডুকরে কাঁদা ভালো ছিলো?
আচ্ছা, বলুন তো, নির্মমতার শিকার হওয়া পারুলের যে ভ্রূণ আজ গর্ভেই ‘শেষ’ হয়ে গেল, সেই ঘটনা কতোটুকু হৃদয়-বিদারক? আপনাদের কি মনে আছে, গুলশানের হোলি আর্টিজানে বোমা হামলার কথা? সেই হত্যাকাণ্ডে নিহত ইতালীয় নাগরিক অন্তঃস্বত্ত্বা নারী সিমোনা মনটি তার অনাগত শিশুর নাম রেখেছিলেন মাইকেল এঞ্জেলো। কিন্তু সেই শিশুটির মতোই কি পারুলের গর্ভে আসা ভ্রুণটাও জন্মের আগেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেনি? কয়েকজন লোভী মানুষের কারণেই কি তার অনাগত শিশুটি ‘নাই’ হয়ে গেলো না পৃথিবীতে আসার আগেই? পারুল কি সেই দিনের অপেক্ষায় ছিলেন যখন তার পেটে এক-দুটো লাথি মেরে সুস্থ থাকার মধুর-জানান দেবে শিশুটি? পারুল নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, একদিন তার সন্তান ‘মা’ বলে ডাক দিয়ে ‘উড়ে’এসে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে?
আমরা হয়তো শারীরিক মৃত্যুকেই একমাত্র মৃত্যু বলে মনে করি। কিন্তু, যখন পারুল বলেন— ‘আমি আমার অনাগত সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারলাম না। এটা বড় যন্ত্রণার, বড় কষ্টের।’ তখন কি আমরা আঙুল দিয়ে দেখাতে পারবো পারুলের হৃদয়ের ঠিক কোন জায়গাটায় কতোটুকু রক্তক্ষরণ হচ্ছে? পৃথিবীর কোনো শব্দ বা ভাষার পক্ষে এ বেদনার গভীরতা ধরা অসম্ভব। মানসিকভাবেও যে আমাদের অসংখ্য মুত্যু হয়’ সেই যন্ত্রণার ভার যে কতোটুকু, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। পারুলকে বলবো, আমরা মানবিক মানুষরা, হয়তো সেই যন্ত্রণাটুকুর ভারটুকু নিতে পারি না কিন্তু অনুভব করতে পারি। আপনাকে সাহস যোগাতে পারি। আপনি আস্থা রাখুন নিজের উপর। বিচার-ব্যবস্থার উপর।
পরিশেষে বলবো, সবকিছু ছাপিয়ে পারুল জীবনের জয়গান গাইতে চাইছেন। নতুন জীবনে হয়তো ‘ভোগান্তি’কম থাকবে না পারুলের। পুরাতন জীবনের স্মৃতিও পলে-পলে কুঁড়ে-কুঁড়ে খাবে পারুলকে। কিন্তু, তবুও বলবো, পারুলরা জয়ী হোক। প্রতিবাদী হোক। পারুলদের প্রতিবাদের মুখেই বিনির্মাণ ঘটুক পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্বের। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-কাঠামোর। নিপাত যাক যৌতুক নামক ঘৃণ্য প্রথার। পারুলরা ‘নহে সামান্য নারী’। পারুল আমাদের সর্বংসহা নন যে ‘হাবি-জাবি সব’ সইয়ে যাবেন নীরবে।
লেখক: শিক্ষক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
madhabdas@cu.ac.bd