তৃষ্ণা পেলে গোটা সমুদ্রই গলাধঃকরণ করতে চায়। যদি কুলায় সাধ্যে। না পারলে এক লিটার, দুই লিটার তো বটেই।

মানুষের সাধ-আহদ্মাদে বাধা দিলে কষ্টের পরিমাণ কতটা বেড়ে যায়, দাঁড়িপাল্লায় মাপা অসম্ভব। 'মনের কথা রইলো মনে/ তোমায় ছেড়ে গেলাম বনে।'

আজকাল বনবাদাড়ও নিঃশেষ। তাই বলে কি শুকনো খালবিল, কংক্রিট, রাস্তাঘাট নেই? গলিত শহর নেই? সবই আছে। সময়-সুযোগমতো ফেরার অপেক্ষা। তারপর মনের সুখে তা ধিন ধিন।

যেমন অতিমারি করোনার কেচ্ছা ধরা যাক। গোটা বিশ্বকে নাজেহাল করে আপাতত চুপ। দাপট কমেনি যদিও। মাথা দিচ্ছে মাঝে মাঝে, এখানে ওখানে। তাই বলে কি 'ঘরের ভেতর বন্দি থেকে/ ডাকবো মরণ অনিমিখে?' না। সহ্যেরও সীমা আছে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। তিন বছরের বেশি।

শুধু ইউরোপ নয়; পাঁচটি মহাদেশ ছেড়ে দে মা (করোনার স্ত্রীলিঙ্গ) কেঁদে বাঁচি বলে হাপিত্যেশ করেছে। কাঁহাতক! আর কত! 'এবার তবে আসুক রাজা/ সবাই মিলে বগল বাজা।' রাজা এসেছে। রাজার নাম খ্রিষ্ট নববর্ষ।

কোন দেশে যুদ্ধ, কোন দেশে বিপ্লব, কোন দেশে হাহাকার- এই নিয়ে মাথা খামচানো এক দিনের জন্য বন্ধ। বছরে একটি দিন। নাম খ্রিষ্ট নববর্ষ। সব দেশেই পালিত, এমন নয়। প্রতিটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিতে নববর্ষ আছে। নববর্ষের আবাহন, উৎসব আছে। সন-তারিখ আছে। থাকলেও, খ্রিষ্ট মাসের দিন-তারিখই বৈশ্বিক। এ-ক্যালেন্ডার, ও-ক্যালেন্ডার সংস্কৃতিগত। কয়েক বছর আগে কায়রোয় গিয়েছিলুম বক্তৃতা উপলক্ষে। ছিল পাঁচ দিনের সাহিত্য সেমিনার। আন্তর্জাতিক। ডিসেম্বর ২৯ থেকে ২ জানুয়ারি। ৩১ তারিখের সান্ধ্য অনুষ্ঠান বাদ। কারণ কী, জিজ্ঞেস করলুম। আয়োজকের একজন বললেন, 'শহর হুল্লোড়ে মাতবে। সর্বত্র নয়, বহু অঞ্চলে, পশ্চিমাঘেঁষা মহল্লায়। কায়রোয় অনেক খ্রিষ্টান, বিদেশি দূতাবাস, দূতাবাসের কর্মী, তাঁদের পরিবার, পোলাপান খ্রিষ্ট নববর্ষ উদযাপনে বাধাহীন। খ্রিষ্ট নববর্ষ উপলক্ষে আমাদের ছুটি নেই। আমরা ইসলামী ক্যালেন্ডার অনুসারী।'

তিউনিসিয়া, মরক্কোয় একই কাণ্ড। দুই দেশের রাজধানীতে (বার্লিনের শীতের প্রকোপ এবং খ্রিষ্ট নববর্ষ উপলক্ষে আতশবাজির শব্দদূষণ থেকে রেহাই পাওয়ার অজুহাতে) (ভিন্ন ভিন্ন বছরে) যে অভিজ্ঞতা, খুব বেশি পার্থক্য নেই। আতশবাজির চমক, ঝলঝলানি ইউরোপের চেয়ে কম নয়। হ্যাঁ, শহরে। শহরের বাইরে যাইনি।

উত্তর আমেরিকা, এশিয়ার চালচিত্র খ্রিষ্ট নববর্ষে এখন অজানা। কলকাতাসহ দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, পানজিম (গোয়ার রাজধানী) স্মৃতি পুরোনো। ৩৬ বছর আগে, নানা শহরে গিয়ে মাতোয়ারা নানাবিধ। তখন যুবরাজ ছিলুম। সখী পরিবেষ্টিত। ইউরোপের চিত্র অনুল্লেখ্য। উত্তর আমেরিকাও। যৌবন সর্বদাই ইন্দ্রের।

বার্লিনের একটি দৈনিকে পড়লুম, ২৯ ডিসেম্বরেই আতশবাজি নিঃশেষ। ৩০ তারিখের জোগানও। ৩১ তারিখে (দুপুর ২টা পর্যন্ত)। বাকিগুলোর দাম চার গুণ। দারুণ ব্যবসা। কেনই-বা নয়?

করোনা মহামারির দাপটে নববর্ষ উদযাপনে আতশবাজি ফোটানো, পোড়ানোয় ঘরবন্দিরা কালের হাওয়ায় অথর্ব। এখন যৌবন। দৈনিকের রিপোর্টে :'২৯-৩০ ডিসেম্বরে আতশবাজি বিক্রি (বার্লিনে) ৩৯ মিলিয়ন ইউরো।'

গোটা জার্মানিতে কত? ৩১ ডিসেম্বরের রিপোর্ট (মিডিয়া) ৮০০ মিলিয়ন ইউরো।

যে-আতশবাজির দাম ছিল (তিন বছর আগে) ১০ ইউরো; এবার ২২, ২৫ (অঞ্চলবিশেষে)।

একজন বললেন, 'টাকা (ইউরো) পোড়ানোর প্রতিযোগিতা, উৎসব। করোনা অতিমারিতে করেনি, টাকা জমিয়েছিল, এবার শ্রাদ্ধ।'

দেখছি খ্রিষ্ট নববর্ষ (২০২৩) আবাহনে আবালবৃদ্ধবনিতা মাতোয়ারা। টাকার (ইউরো) শ্রাদ্ধে অকৃপণ। নববর্ষ বলে কথা! গির্জায় অন্য চিত্র। ২০২৩ সালে শান্তির প্রার্থনা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানে। আমেরিকার বদমাইশি বলতে পারব না। আমেরিকা, ন্যাটো চায় যুদ্ধ জিইয়ে রাখতে। মূলে ব্যবসা। এরই মধ্যে আমেরিকা বিশাল অর্থে লাভবান। ঠুঁটো জগন্নাথ ন্যাটোভুক্ত দেশ। ছেড়ে দে মা বলার সাহসও নেই।

ইতিহাসে উল্লেখ পাচ্ছি না, ৩১ ডিসেম্বর, খ্রিষ্টবর্ষ স্বাগতে ১ জানুয়ারি আতশবাজির নাম কেন 'বেঙ্গলিশে ফয়ার'। জার্মান নাম।

'বেঙ্গলিশে ফয়ার' মানে (জার্মান ভাষায়) বাংলার আগুন।

আমরা বলি, (বাঙালি) আগুন জ্বালিয়েছি বিশ্বে। সুগায়ক মঈন চৌধুরীর স্ত্রী রিটা শেফার বলেন, 'আগুন সংসারেও। জ্বলন্ত। উত্তাপে বাংলাদেশ-জার্মানি।' টাকা (ইউরো) পোড়ানোয় (আতশবাজি) কন্যা লেনাকে নিয়ে (মঈন চৌধুরীর সঙ্গে) স্বতঃস্ম্ফূর্ত। খ্রিষ্টবর্ষ-স্বাগতে বাংলাদেশও। হালের বাংলাদেশ কতটা উন্মাতাল, অজানা।

দাউদ হায়দার: কবি