
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রায় পরিত্যক্ত ঘোষিত ১৪ দলীয় জোটকে আওয়ামী লীগ আবারও চাঙ্গা করতে চাইছে। এরই মধ্যে শাসক দল ঘোষণা করেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে তারা জোটগতভাবে অংশ নেবে। এমনকি, দৃশ্যত এ ক্ষেত্রে তাদের আন্তরিকতার প্রমাণস্বরূপ ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় উপনির্বাচনে পাঁচটি আসনের দুটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের। অতীতের অনেক নির্বাচনে অন্যথা হলেও এবার ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদকে ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোতে শাসক দলের কোনো 'বিদ্রোহী' প্রার্থীও নেই। বলা বাহুল্য, সম্প্রতি সংসদ থেকে বিএনপি সদস্যদের পদত্যাগের কারণে আসনগুলো শূন্য হয়।
প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদারের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ২৩ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন ওয়ার্কার্স পার্টি, হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদসহ প্রধানত কয়েকটি বাম দল নিয়ে আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোট গঠন করে। পরবর্তী সময়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, তরীকত ফেডারেশনসহ আরও কয়েকটি দল এতে যোগ দেয়। আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময়ে একে 'আদর্শিক জোট' হিসেবে বর্ণনা করেছে। সম্ভবত এ কারণেই ২০০৮ সালের নির্বাচন সামনে রেখে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে নিয়ে তখন 'মহাজোট' গঠন করলেও ্বৃহত্তম শরিক দলটি ১৪ দলীয় জোটকে কম গুরুত্ব দেয়নি। দলটি রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে টানা তিন মেয়াদ। প্রথম দুই মেয়াদেই জোট শরিকদের তারা মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়। এর মধ্য দিয়ে রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু যেমনটা প্রায়ই বলে থাকেন- আওয়ামী লীগ 'একসঙ্গে আন্দোলন, একসঙ্গে নির্বাচন ও একসঙ্গে সরকার পরিচালনার' ১৪ দলীয় অঙ্গীকার রক্ষা করেছে।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনও ১৪ দলীয় জোট একসঙ্গেই করেছে। কিন্তু নির্বাচনটিতে আড়াইশর বেশি আসন পেয়েই আওয়ামী লীগ ওই ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটায়। এর শীর্ষ নেতারা অনেকটা পরিত্যাজ্য ঘোষণার মতো করে শরিকদের 'অযাচিতভাবে' বিরোধীদলীয় রাজনীতি করার পরামর্শ দিতে থাকেন। আগের দুই মেয়াদে সরকারকে মহাজোট বা ১৪ দলীয় সরকার বলা হলেও ২০১৮-পরবর্তী সরকারকে বলা হয় আওয়ামী লীগ সরকার। বিশেষ করে বাম শরিকদের তরফ থেকে এতে আপত্তি জানিয়ে বলা হয়, নির্বাচনে জনগণের কাছে উন্নয়ন অব্যাহত রাখার স্বার্থে সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষার আহ্বান জানিয়ে ভোট চাওয়ার পর তাদের পক্ষে সরকারের বিরোধিতা সম্ভব নয়। কিন্তু এসব একেবারেই পাত্তা না দিয়ে সরকারি দল তাদের অবস্থানে অনড় থাকে। এ কারণেই আজ যখন ১৪ দলের, বিশেষত বাম শরিকদের 'শাসক দলের তরফ থেকে' বেশ খায়খাতির চলছে, তখন প্রশ্ন উঠেছে- তবে কি সরকার চাপে পড়েছে? সামলাতে না পেরে পুরোনো বন্ধুদের কাছে টানছে?
২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির ফল খুবই খারাপ হয়; দলটি মাত্র ছয়টি আসন পায়। মূলত নানা বিতর্কিত উপায়ে জনসমর্থনের দিক দিয়ে বেশ জোরালো দল বিএনপির এমন হাল করা হলেও শাসক দল কিন্তু এতে অস্বাভাবিক আত্মতুষ্টিতে ভুগতে থাকে। দলটির নেতাদের মধ্যে এমন একটা ভাব তৈরি হয় যে তাঁরা একাই একশ। আগামী দিনে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে কারও সাহায্য তাঁদের প্রয়োজন নেই। সম্ভবত অতি আত্মবিশ্বাস থেকেই তাঁরা তখন ১৪ দলকে 'বাহুল্য' হিসেবে দেখতে থাকেন।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই- ব্যাংক খাতে আর্থিক কেলেঙ্কারি, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির খবর, অস্বাভাবিক প্রকল্প ব্যয়ের অভিযোগ সত্ত্বেও এ সরকারের আমলে শুধু অবকাঠামো খাতেই নজিরবিহীন ও নজরকাড়া উন্নয়ন ঘটেছে। জনগণের ব্যাপক অংশের জীবনমানও আগের চেয়ে বেশ উন্নত হয়েছে। একই সঙ্গে শিল্প ও কৃষিতে মনোযোগ নিবদ্ধ করার কারণে অন্তত সমাজের নিচুতলায় আগের মতো হাহাকার নেই। প্রায় সব বর্গের বিপন্ন মানুষের জন্য বহুবিধ ভাতা চালুর পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে এ আমলে রীতিমতো উল্লম্ম্ফন ঘটেছে। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের অন্তত জনসমর্থন নিয়ে চিন্তিত থাকার কথা নয়। কিন্তু ভোটের ক্ষেত্রে বিশেষত, ২০১৮ সালের নির্বাচন যেভাবে সম্পন্ন হয়, তা সচেতন মহল তো বটেই, সাধারণ ভোটাররাও ভালোভাবে নেননি।
প্রত্যক্ষ কোনো প্রমাণ না থাকায় অনেক দিন পর্যন্ত শাসক দল এসব কেলেঙ্কারি নিয়ে বিএনপি বা সরকারবিরোধীদের সমালোচনা ভালোই সামাল দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ছাইচাপা থাকলেও আগুন আগুনই; একসময় তা ঠিকই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তেমনি ওই ভোট কেলেঙ্কারিগুলো ক্রমেই জনপরিসরের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে থাকে। সরকারের একেবারে একলা চলো নীতিতে বিরক্ত হয়ে এক পর্যায়ে মহাজোট ও ১৪ দলের কোনো কোনো শরিকও সেগুলো বলতে থাকে। আজ যা শুধু জাতীয় পরিসরেই বিরূপ আলোচনার বিষয় নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও বেশ সমালোচিত।
ওই নির্বাচনটা যদি মোটামুটি নিয়ম মেনে সম্পন্ন হতো, তাহলেও আজ যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোর কূটনীতিকরা- এমনকি সরকারের বন্ধু বলে পরিচিত জাপানি রাষ্ট্রদূতও- রীতিমতো সরকারের মুখের ওপর বলতে পারত না, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ বা সুষ্ঠু না হলে তাদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। তারা কিন্তু শুধু তা-ই বলছে না; নির্বাচনের কথা বলতে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ এমন সব অভিযাগও আনছে, যেগুলো এ দেশের অতীত সরকারগুলোর আমলে তো বটেই, অন্য যে কোনো উন্নয়নশীল দেশেও আকছারই ঘটে থাকে। এটা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের এমন সব চাপ তৈরির পেছনে এ অঞ্চলে তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ প্রবলভাবে আছে। কিন্তু এর সুযোগ যে অনেকাংশে ওই বিতর্কিত নির্বাচনই করে দিয়েছে তা-ও অস্বীকার করা যায় না।
যা হোক, ১৪ দলকে পুনরুজ্জীবিত করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ আবারও প্রমাণ করল, বাংলাদেশে যেখানে বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের কারণে রাজনৈতিক মেরূকরণ প্রায় আদর্শিক, সেখানে শুধু ক্ষমতা ধরে রাখা বা ফিরে পাওয়ার জন্য নয়; প্রতিপক্ষকে সফলভাবে মোকাবিলা করার স্বার্থেও জোট চর্চা অপরিহার্য। বঙ্গবন্ধু প্রায় একক হাতেই বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি বুঝতে পারেন- আওয়ামী লীগের একার পক্ষে ক্ষমতা ধরে রাখা সম্ভব নয়। তিনি সিপিবি ও ন্যাপকে নিয়ে জোট গড়ে তোলেন।
জোট চর্চার এ বাস্তবতা প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ায়ও বিদ্যমান। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এমনকি ইউরোপও এ বাস্তবতা এড়াতে পারছে না। তবে এ বাস্তবতা আওয়ামী লীগ কতটুকু উপলব্ধি করছে, তা বুঝতে আমাদের আগামী দিনগুলোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
মন্তব্য করুন