
দেশে নিয়ম ভাঙা-গড়ার খেলা দেখছি আমরা। নিয়ম ভাঙাই অনেকের ক্ষেত্রে নিয়মে পরিণত হয়েছে। 'সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠে না'- প্রবাদ বাক্যটি আমরা সবাই শুনেছি নিশ্চিত। তাই 'সোজা' বলে কিছু নেই- এটিই সবার ধারণা। ফলে সবকিছুই বাঁকা পথে চলে। যেমন পেনশনের টাকা ওঠাতে যাবেন? সহজভাবে হবে না। কী করতে হবে? আঙুল বাঁকা করতে হবে। ক'জন পেনশনধারী সোজা পথের সন্ধান পেয়েছেন?
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যাবেন, পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করতে যাবেন, তখন বুঝতে পারবেন বাঁকা পথটাই অনেকের জন্য সোজা পথ। ধরা যাক, কাউকে আইন ভঙ্গের জন্য ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হলো। কিন্তু সেই জরিমানা আদায়ের আগেই ১০ হাজার টাকায় রফা হয়ে যাওয়া ঠেকাবে কে? এটিকে বলা হয় 'সিস্টেম'। এই সিস্টেম এক দিনে তৈরি হয়নি।
বছরের শুরুতে বই দেওয়া হলো, প্রথমে যে খবরটি জানলাম, সেটি ছিল 'নতুন বইয়ে পুরোনো ভুল'। খবরটিতে যেসব ভুলের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, যেমন- একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতেই যে পাকিস্তান বাহিনী বাঙালি হত্যাযজ্ঞ বা জেনোসাইড শুরু করেছিল, সেটি জানা নেই- এমন মানুষ কীভাবে পাঠ্যবই লেখার দায়িত্ব পান? রাজারবাগ পুলিশ লাইনসকে পুলিশ ক্যাম্প, পিলখানা ইপিআর সদরদপ্তরকে ইপিআর ক্যাম্প বানানো রীতিমতো মূর্খতা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে!
ভুল ও বিকৃত তথ্য ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে বানান ও ব্যাকরণগত ভুলের কথা বলা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুলভাবে উপস্থাপন করা কোনো মুক্তিযোদ্ধার রক্তে থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না। এত কিছুর পরও পাঠ্যবইয়ে ভুলের বিষয়টি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি কর্তৃপক্ষের নজরে কেন যে আসেনি, সেটি ভাবতেও অবাক লাগে। আবার নজরে আসার পরও সংশোধনের বিষয়ে যদি গাফিলতি করা হয়, তাও মার্জনা করার মতো নয়।
ব্রিটিশ আমল থেকে প্রশাসনের ওপর মানুষের নেতিবাচক মনোভাব ছিল। এই নেতিবাচক ধারণা এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। কথায় বলে, 'আকাশের যত তারা, প্রশাসনের হাতে তত ধারা।' আমি দেশে ছোটবেলা থেকেই এসবের কিছু নমুনা দেখে অভ্যস্ত। তবে প্রশাসন ভালো কাজও করেছে। ভালো কাজ যদি করে থাকে ১০টি আর মানুষের চোখে লাগার মতো অন্যায় কাজ করে যদি ১০টি, তাহলে ভালো কাজটি আড়ালে পড়ে যায়। মানুষ নেতিবাচক কাজটিকেই প্রাধান্য দেয়, মনে রাখে এবং আলোচনা করে পথ-ঘাট, চায়ের দোকান ও বন্ধুমহলের আড্ডায়।
আমরা জানি, সরকারি সংস্থা- সাধারণের করের টাকায় রাষ্ট্র্র তাদের বেতন-ভাতা, চিকিৎসা, অল্প দামের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ অন্যান্য চাহিদা পূরণ করে থাকে। তাদের দায়িত্ব সেবা দেওয়া, ভালো কাজ করা, ন্যায় কাজ করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। এটিই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যেটা হওয়া উচিত, সেটার ব্যাপারে মানুষ প্রশংসা করবে- এটিই মানুষের আশা। তবে যেসব কাজ তাদের করার কথা নয়, সেসব কাজ যদি অল্পবিস্তরও করে তাহলে মানুষ অবশ্যই এটি নিয়ে সমালোচনা করবে।
যাক এসব পুরোনো কথা, বরং একটু নতুন কিছু নিয়ে ভাবি। আমি সুইডেনের কুকুর, বিড়াল, খরগোশসহ নানা ধরনের গৃহপালিত পশুপাখি দেখি। এদের কেউ কেউ যেমন- তোতা পাখি দিব্বি কথা বলতে পারে। কুকুর-বিড়াল এমনকি খরগোশ এদের ঘরের গুরুত্বপূর্ণ কাজে সাহায্য করে বিশ্বস্ততার সঙ্গে। তবে বন-জঙ্গল বা পানিতে যারা বসবাস করে, তারা তেমন শান্তশিষ্ট না; যে যারে পারে- ধরে, মারে, খায়। একটি জিনিসের মধ্যে চরম আকারে মিল, সেটি হলো- বনের জীবজন্তুর সঙ্গে আমাদের আচরণের মিল। যেমন আমরা যারা দেশের ছোটখাটো নাগরিক, বড় দেশের কথা শুনলে ভয়ে চুপচাপ থাকি; জঙ্গলে যারা বসবাস করছে, তাদেরও ঠিক একই দশা। তবে গৃহপালিত পোষা কুকুর, বিড়াল, খরগোশ, হাঁস, মুরগি এমনকি শূকরের আচরণে আমি বেশ মুগ্ধ হয়েছি। ফলে যখন শুনি বা জানি কারও সমস্যা, চেষ্টা করি কিছু করতে। ওই যে বললাম না, আমি সুইডেনের গৃহপালিত পশুপাখির থেকে শিখেছি তাই।
মন্তব্য করুন